প্রাকৃতিক খাদ্য
কোন জলাশয়ের পানি ধারণের আধার হলো মাটি। মাটির গুণাগুণ পানির গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। মাটি ও পানির স্বাভাবিক উর্বরতায় কোন জলাশয়ে যেসব খাদ্যদ্রব্য উৎপাদিত হয় সেগুলোকে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য বলা হয়। সার প্রয়োগের মাধ্যমে পুষ্টি সরবরাহ করে পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন করা যায়। প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রধান উৎস। কোন জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ততা উক্ত জলাশয়ের প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা নির্দেশ করে।
প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎস
উদ্ভিদ-প্রাণী নির্বিশেষে পানিতে স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান প্রায়সব জীবই মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎস। এ ছাড়াও পানির তলদেশে ও কাদার উপরে অবস্থানকারী জীব নয় এমন পচা জৈববস্তুও মাছ প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এসব পচা জৈববস্তুতে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া লেগে থাকে, যেগুলো অধিক পুষ্টিমান সমৃদ্ধ এবং মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। মাছের এসব প্রাকৃতিক খাদ্য প্রধানত শিকার ও শিকারী এরূপ ভূমিকায় পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে এবং খাদ্য, স্থান ইত্যাদির জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। জৈব বস্তুর এরূপ পারস্পরিক সম্পর্ককে খাদ্যচক্র বলা হয়। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপন্ন হয়।
জলজ পরিবেশে প্রাপ্ত মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যকে নিম্নরূপ ৬টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা-
- প্ল্যাঙ্কটন (plankton)
- পেরিফাইটন (periphyton)
- নেকটন (nekton)
- নিউসটন (neuston)
- বেনথোস (benthos) এবং
- ম্যাক্রোফাইট (macrophyte)
প্ল্যাংঙ্কটন
পানিতে বিদ্যমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবকণা, অর্থাৎ আণুবীক্ষণিক প্রাণী ও উদ্ভিদকে প্ল্যাংঙ্কটন বলা হয়। প্ল্যাংঙ্কটন পানির ঢেউ বা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে পারে না। স্রোত বা ঢেউয়ের তালে তালে এরা নিসিক্রয়ভাবে ভেসে বেড়ায়। প্ল্যাংঙ্কটন মাছের প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য। পানিতে প্ল্যাংঙ্কটন বেশি থাকা পুকুরের অধিক উৎপাদনশীলতা নির্দেশ করে। প্ল্যাংঙ্কটনের আধিক্যে পানির বর্ণ সবুজ বা বাদামী দেখায়। প্ল্যাংঙ্কটন দুই প্রকার, যথা-
- উদ্ভিদ প্ল্যাংঙ্কটন (phytoplankton) এবং
- প্রাণী প্ল্যাংঙ্কটন (zooplankton)।
- উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটনঃ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদই উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন। এগুলোর বর্ণ সবুজ। উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাথমিক উৎস। যেমন- অ্যানাবেনা (Anabaena), স্পাইরোগাইরা (Spirogyra), নাভিকুলা (Navicula), পলিটোমেল্লা (Polytomella), পেডিয়েস্ট্রাম (Pediastrum), সিনেডেসমাস (Scenedesmus), ফেকাস (Phacus) ইত্যাদি।
- প্রাণী প্ল্যাঙ্কটনঃ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী ও কীটপতঙ্গের লার্ভাকে প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন বলা হয়। প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের দ্বিতীয় বা মধ্যম পর্যায়ের উৎস। জুওপ্ল্যাঙ্কটন প্রাণিজ খাদ্যের প্রথম উৎস। যেমন- ড্যাফনিয়া (Daphnia), সাইক্লপ্স্ (Cyclops), ডায়াপটোমাস (Diaptomus), কেরাটেল্লা (Keratella), ফিলিনিয়া (Filinia), ব্রাকিওনাস (Brachionus), পলিআর্থ্রা (Polyarthra) ইত্যাদি।
পেরিফাইটন
- পেরিফাইটন হলো ঐসব ক্ষুদে উদ্ভিদ ও প্রাণী যারা শিকড়যুক্ত ও অপেক্ষাকৃত বড় জলজ উদ্ভিদের শাখা প্রশাখায় লেগে থাকে বা পানির তলদেশের শক্ত কোন আশ্রয়ে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে জীবন যাপন করে।
নেকটন
- অপেক্ষাকৃত বড় ধরনের জলজ প্রাণী যারা মুক্তভাবে সাঁতার কাটতে পারে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে, তাদেরকে নেকটন বলা হয়। নেকটন প্ল্যাঙ্কটন নেটে ধরা পড়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে। যথা- ওয়াটার বীট্ল, ক্ষুদে উভচর প্রাণী, জলজ পোকা মাকড় ইত্যাদি।
নিউসটন
- পানির উপরিভাগে ঝুলে থেকে বা ভাসমান অবস্থায় সাঁতাররত বা বিশ্রামকারী জীবকে নিউসটন বলা হয়। যথা- প্রোটোজোয়া, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি।
ব্যানথোস
- পানির তলদেশে কাদার উপরিভাগে বা কাদার মধ্যে বসবাসকারী জীবকে ব্যানথোস বলা হয়। যথা- শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি।
ম্যাক্রোফাইট
- অপেক্ষাকৃত বড় ধরনের জলজ উদ্ভিদকে ম্যাক্রোফাইট বলা হয়। যথা- ক্ষুদে পানা, কুটি পানা ইত্যাদি।
প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা
মাছ চাষের জন্য জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমিত যোগানদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের খাদ্য চক্রকে সচল রাখে। ফলে জলাশয়ে মাছের বিভিন্ন প্রকার খাদ্য উপাদান চক্রাকারে ও অবিরতভাবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। এতে মাছের দেহের স্বাভাবিক পুষ্টি সাধন ও বৃদ্ধি ঘটে থাকে এবং জলাশয়ের জৈব ভারসাম্য (biological equilibrium) বজায় থাকে। ব্যাপক ভিত্তিক (extensive) মাছ চাষের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খাদ্যই মাছের পুষ্টির একমাত্র উৎস।
প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের স্বাভাবিক খাবার। এজন্য মাছ সহজেই প্রাকৃতিক খাদ্য গ্রহণ করে। প্রাকৃতিক খাদ্যের পুষ্টিমান বেশি এবং এগুলো সহজেই হজম হয়। এ কারণে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিবর্তন হার (conversion rate) সূচক সংখ্যামান কম, যা অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করে।
গোবর, হাস-মুরগির বিষ্ঠা ইত্যাদি জৈব সার সহজলভ্য এবং দামে অপেক্ষাকৃত সস্তা। এসব জৈব সার ব্যবহার করে পানিতে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাংঙ্কটন জলাশয়ের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
শেপারক্লাউস (Schaperclaus) মনে করেন যে কার্পজাতীয় মাছ চাষের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাদ্যের ৫০ শতাংশ প্রাকৃতিক খাদ্য হওয়া উচিত। তাল এবং হেপার (Tal and Hapher) তাঁদের পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখেছেন যে, পুকুরে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্য কার্প জাতীয় মাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। তেলাপিয়ার জন্য পুকুরে ন্যূনতম ১০ শতাংশ প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগান থাকা দরকার।
পুকুরের বিভিন্ন স্তর হতে খাদ্য গ্রহণকারী বিভিন্ন প্রজাতির মাছকে যথাযথ পরিমাণে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা যায় না। তাছাড়া, সব প্রজাতির মাছ সম্পূরক খাদ্য গ্রহণের সমান উৎসাহ দেখায় না। আবার একই জলাশয়ে একই সময়ে বিভিন্ন ধরণের সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য।
কৃত্রিম বা সম্পূরক খাদ্য প্রাকৃতিক খাদ্যের বিকল্প নয়, পরিপূরক মাত্র। অনেক সময় সম্পূরক খাদ্য সুষম হয় না। এ জন্য মাছ চাষে প্রকৃতিক খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
- মাটি ও পানির স্বাভাবিক উর্বরতায় কোন জলাশয়ে যেসব খাদ্যদ্রব্য উৎপাদিত হয় সেগুলোকে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য বলে;
- প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রধান উৎস;
- উদ্ভিদ প্রাণী নির্বিশেষে পানিতে স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান প্রায় সব জীবই মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য। বেনথোস, ম্যাক্রোফাইট ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়;
- মাছ চাষের জন্য জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমিত যোগানদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ;
- কৃত্রিম বা সম্পূরক খাদ্য প্রাকৃতিক খাদ্যের বিকল্প নয়, পরিপূরক মাত্র;
- উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খাদ্যই মাছের পুষ্টির একমাত্র উৎস
তথ্য সূত্র: DoF