বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা
সৈয়দ আরিফ আজাদ
 
সুস্থ-সবল ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় অর্থনীতিতে এ সম্ভাবনাময় সেক্টরের ভূমিকা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বলা যায়, এ দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১২-১৩ সনে মাছের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪.১০ লাখ টনে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩-এর তথ্যমতে, এ দেশের মোট দেশজ উৎপাদ বা জিডিপির ৪.৩৭ শতাংশ এবং মোট কৃষিজ জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৩.৩৭ শতাংশ) মৎস্য খাতের অবদান। সাম্প্রতিক সময়ে মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কৃষির অন্যান্য উপ খাত যেমন- শস্য, প্রাণিসম্পদ ও বনের তুলনায় অনেক বেশি। এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিধানেও মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রায় ৬০% প্রাণিজ আমিষের জোগান দেয় মাছ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক লোক এ সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। বিগত পাঁচ বছরে এ খাতে বার্ষিক অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৬ লক্ষাধিক লোকের। দেশের রপ্তানি আয়ের ২ শতাংশের অধিক আসে মৎস্য খাত থেকে। গত পাঁচ বছরে মৎস্য উৎপাদনে গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫.৮৮ শতাংশ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০২১-এ উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মৎস্য অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মৎস্য সেক্টরে অর্জিত হয়েছে দৃশ্যমান সাফল্য। আশা করা যায় ২০১৪-১৫ সনের মধ্যে ইপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকাংশেই সম্ভব হবে।
 
২০১৪-১৫ সনের মধ্যে অর্জিতব্য লক্ষ্যমাত্রা

  • মাছের উৎপাদন ২০০৮-০৯ (২৭.০১ লাখ টন)-এর চেয়ে ২৫% বৃদ্ধিকরণ,
    (২০১২-১৩ সনের মধ্যেই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ ২৬.২৫% বৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে)
  • জনপ্রতি ৫৬ গ্রাম আমিষের চাহিদা পূরণ,
    (২০১২-১৩ সালের মধ্যে জনপ্রতি আমিষের প্রাপ্তি ৫২ গ্রামে উন্নীত হয়েছে)
  • চিংড়ি ও মংস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক আয় ১ বিলিয়ন ইউএস ডলারে উন্নীতকরণ,
  • বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা,
    (বিগত ৫ বছরে বার্ষিক অতিরিক্ত কর্মসংস্থান প্রায় ৬ লাখ)
  • মৎস্যচাষি/মৎস্যজীবীদের আয় ২০% বৃদ্ধিকরণ,
  • মৎস্যচাষে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ,
    (মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে গড়ে ২০ শতাংশ মহিলার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে)
  • দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ।
  • বাজারে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ।

মৎস্য খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য ও উন্নয়ন সম্ভাবনা
১. মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান : দেশের মৎস্যসম্পদের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিভিন্ন সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৭.০১ লাখ টন, সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ তথা মৎস্যবান্ধব কার্যক্রম এবং চাষি-উদ্যোক্তা পর্যায়ে চাহিদামাফিক কারিগরি পরিসেবা প্রদানের ফলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৪.১০ লাখ টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদনের ইপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা ৩৫.৫৫ লাখ টন অর্জিত হবে বলে প্রাথমিক তথ্যে প্রতীয়মাণ হয়। প্রবৃদ্ধির এ ক্রমধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২০-২১ সনের মধ্যে দেশে মৎস্য উৎপাদন ৪৫.৫২ লাখ টন অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়। ফলে ২০২০-২১ সনে দেশের বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রক্ষেপিত মৎস্য চাহিদা (৪৫.২৮ লাখ টন) পূরণ করা সম্ভব হবে। গত ১০ বছরের মৎস্য উৎপাদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক (গড় প্রবৃদ্ধি ৫.৪৯ শতাংশ) এবং এ ক্ষেত্রে প্রায় স্থিতিশীলতা বিরাজমান।

দেশে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে দরিদ্র মৎস্যজীবীদের আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে দেশের ১১ শতাংশের অধিক বা প্রায় ১৭১ লাখ লোক তাদের জীবন-জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য উপ খাতের ওপর নির্ভরশীল। মৎস্য সেক্টরে সংশ্লিষ্ট এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ নারী, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ। এছাড়াও বিগত পাঁচ বছরে এ সেক্টরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অতিরিক্ত বার্ষিক ৬ লক্ষাধিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোতে নিয়োজিত শ্রমিকের ৮০ শতাংশের অধিক নারী।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের (নদী, সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, বিল ও প্লাবনভূমি) পরিমাণ প্রায় ৩৯ লাখ ২০ হাজার হেক্টর, বদ্ধ জলাশয়ের (পুকুর, মৌসুমি চাষকৃত জলাশয়, বাঁওড় ও চিংড়ি ঘের) পরিমাণ ৭ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর, সামুদ্রিক পানিসীমার পরিমাণ ১ লাখ ৬৬ হাজার বর্গ কিমি. এবং সমুদ্র উপকূল রয়েছে ৭১০ কিমি.। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ১৯৮৩-৮৪ সনে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৭.৫৪ লাখ টন, সেখানে তিন দশকের ব্যবধানে এ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৪.১০ লাখ টন। বিগত প্রায় তিন দশকের খাতওয়ারি উৎপাদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৮৩-৮৪ সনে উন্মুক্ত জলাশয়ের অবদান ৬৩ শতাংশ হলেও ২০১২-১৩ সালে এ খাতের অংশ দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশে। অন্যদিকে প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে বদ্ধ জলাশয়ের অবদান সাড়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদন হ্রাস না পেলেও প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি মূলত বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণেই।

২. পোনা অবমুক্তি কার্যক্রম ও বিল নার্সারি স্থাপন : উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্তি কার্যক্রমের আওতায় ২০১৩-১৪ বছরে রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় দেশব্যাপী প্রায় ৪৯০ টন গুণগতমানসম্পন্ন ও বিপন্ন প্রায় প্রজাতির পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরে মোট পোনামাছ অবমুক্তির পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন হাজার টন। এ পোনামাছ অবমুক্তি কার্যক্রমের ফলে বার্ষিক প্রায় ৭,৫০০ টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হচ্ছে এবং এরই মধ্যে অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের আবির্ভাব ঘটেছে। তাছাড়া এ সরকারের আমলেই মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো বিল নার্সারি কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। বিগত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত পাঁচ বছরে রাজস্ব বাজেটে মোট ৭১৫টি বিল নার্সারি স্থাপিত হয়েছে। ২০১৩-১৪ বছরে বিল নার্সারি স্থাপন করা হয়েছে ২০৬টি। প্রাথমিক তথ্যে দেখা যায়, এ কার্যক্রম পরিচালনার ফলে দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে বার্ষিক প্রায় দুই হাজার টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হচ্ছে এবং জলমহালের ওপর নির্ভরশীল জেলে/ সুফলভোগীদের আয় বৃদ্ধিসহ স্থানীয় পর্যায়ে প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশব্যাপী বিল নার্সারি কার্যক্রম আরো স্থায়িত্বশীল করার লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি ১১৮ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ে বিল নার্সারি স্থাপন ও পোনা অবমুক্তকরণ শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করেছে।

৩. সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন : জলাশয় সংশ্লিষ্ট মৎস্যজীবী-জেলেসহ সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জলাশয়ের জৈবিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকার এরই মধ্যে সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। এ নীতির আওতায় অভ্যন্তরীণ জলসম্পদের স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য জলাশয় সংশ্লিষ্ট সুফলভোগী/জেলেদের সমন্বয়ে সমাজভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বিপন্ন প্রায় মৎস্য প্রজাতির সংরক্ষণ, প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম স্থাপন একটি অন্যতম কারিগরি কৌশল। বিগত পাঁচ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৫৩৪টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাঁচ বছরে স্থাপিত ৫৩৪টি অভয়াশ্রমসহ বর্তমানে দেশব্যাপী প্রায় ৫৫০টি অভয়াশ্রম স্থানীয় সুফলভোগী কর্তৃক সফলতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। এসব অভয়াশ্রম স্থাপনের ফলে বিপন্ন প্রায় মৎস্য প্রজাতি যথা-চিতল, ফলি, বামোস, কালিবাউস, আইড়, টেংরা, মেনি, রানী, সরপুঁটি, মধু পাবদা, রিটা, কাজলী, চাকা, গজার, তারা বাইম ইত্যাদি মাছের প্রাপ্যতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

৪. পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ : চিংড়ি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়ি খামারে উত্তম চাষ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। এসব খামারে পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সমন্বিত চিংড়ি-শস্য/সবজি চাষ ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হচ্ছে। জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা ২০১৪ অনুমোদিত হয়েছে। আশা করা যায়, এ নীতিমালা মোতাবেক পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও লাগসই সম্প্রসারণ সেবা প্রদান, চাষি প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী খামার পরিচালনা ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে চিংড়ি খামার থেকে কাক্সিক্ষত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি একটি স্থায়িত্বশীল চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনার প্রবর্তন সম্ভব হবে। নানাবিধ অপপ্রচার ও নেতিবাচক কার্যক্রমকে মোকাবিলা করে এ ক্রমবর্ধনশীল শিল্পকে অধিক স্থায়িত্বশীল করার লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর সরকারি-বেসরকারি  সুফলভোগীদের নিয়ে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

চাষিপর্যায়ে রোগমুক্ত ও গুণগতমানসম্পন্ন চিংড়ি পোনার সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৬টি জীবাণু শনাক্তকরণের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ড ফিশের যৌথ উদ্যোগে পিসিআর প্রটোকল তৈরির পাশাপাশি পিসিআর পরীক্ষিত পোনা মজুদের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া চিংড়ি চাষকে আরো লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব করার নিমিত্ত জলাশয় বা ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চিংড়ির পিএল নার্সিং-এর মাধ্যমে ঘেরে জুভেনাইল মজুদের বিষয়ে চাষি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
 
তাছাড়া চিংড়ি চাষকে আরও লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব করার নিমিত্ত জলাশয় বা ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চিংড়ির পিএল নার্সিং-এর মাধ্যমে ঘেরে জুভেনাইল মজুদের বিষয়ে চাষি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ক্লাস্টার ফার্মিং পদ্ধতি প্রবর্তনের। বাংলাদেশে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো হাওয়াই, আমেরিকা থেকে এসপিএফ বা রোগমুক্ত বাগদা চিংড়ি আমদানির মাধ্যমে চিংড়ির পিএল উৎপাদন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।  

৫. ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন : ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম কৌশল হচ্ছে জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ। ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম সুরক্ষা করা সম্ভব হলে সারা বছর ইলিশ প্রাপ্তি সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের নিরাপদ প্রজননের জন্য প্রতি বছর আশ্বিন মাসের প্রথম উদিত চাঁদের পূর্ণিমার দিনসহ আগের তিন দিন ও পরের সাত দিন (মোট ১১ দিন) উপকূলীয় এলাকাসহ দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, বিক্রয় ও মজুদ নিষিদ্ধ করে আইন সংশোধন করা হয়েছে।

২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৬টি জেলার ৮৮টি উপজেলায় ২,০৬,২২৯টি জাটকা জেলে পরিবারের মধ্যে পরিবার প্রতি মাসিক ৩০ কেজি হারে চার মাসের জন্য মোট প্রায় ২৪,৭৫০ টন খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়। তারই ক্রমধারায় আরও বর্ধিত কলেবরে ২০১৩-১৪ সনে জাটকা আহরণে বিরত জেলেদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য জাটকা সমৃদ্ধ ১৫ জেলার ৮১টি উপজেলায় ২,২৪,১০২টি জাটকা জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ৪ মাসের জন্য মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় মোট ৩৫,৮৫৬ টন চাল প্রদান করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিগত ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৭-০৮ সনে জেলেদের সহায়তা কর্মসূচিতে খাদ্যশস্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৬,৯০৬ টন। সেখানে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত এ সরকারের বিগত ৬ বছরে এ সহায়তা দেয়া হয়েছে ১,২২,৯২৫ টন।

তাছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি কার্যক্রমের আওতায় ২০১৩-১৪ বছরে ১১৬৫ জনসহ বিগত পাঁচ বছরে সর্বমোট ২১,৯৫০ জন সুফলভোগীকে বিষয়ভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, ভ্যান-রিকশা চালানো, সেলাই মেশিন, ইলিশ ধরার জাল প্রদান, খাঁচায় মাছ চাষ ইত্যাদি আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০,৫৫৯ জন জাটকা জেলেকে এ সহায়তা প্রদান করা হবে। ইলিশ ও জাটকাবিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম আরও বেগবান ও কার্যকর করার নিমিত্ত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক একটি অত্যাধুনিক জলযান ক্রয় করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৩.৮৫ লাখ টন, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৫ হাজার কোটি টাকার ওপর।

৬. মৎস্যজীবী-জেলেদের পরিচয়পত্র প্রদান : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগে সরকার প্রকৃত জেলেদের শনাক্ত করে নিবন্ধকরণ ও পরিচয়পত্র প্রদানের লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। দেশব্যাপী প্রায় ২০ লাখ মৎস্যজীবী-জেলের মধ্যে ২০১৩-১৪ সনের মধ্যে সাড়ে আট লাখ মৎস্যজীবী-জেলেদের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা যায়, ২০১৪-১৫ সনের মধ্যে প্রকল্পের আইডি কার্ড প্রদানের ইপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এ কার্যক্রমের ফলে প্রকৃত জেলেদের জলমহাল ব্যবস্থাপনায় অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সরকারি প্রণোদনা ও সহায়তা প্রদান সহজতর হবে। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে (ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি) জীবননাশ ঘটলে জেলে পরিবারকে এ প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হবে। তাছাড়া এ পরিচয়পত্র ইলিশ জেলেদের চিহ্নিতকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, যার ফলে চলমান ভিজিএফ ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি কার্যক্রম আরও ফলপ্রসূ হবে।

৭. মাছের আবাসস্থল উন্নয়ন : বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, বরোপিট, হাওর-বাঁওড় ও নদী-নালা মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও অবাধ বিচরণের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ সব জলাশয় সংস্কার, পুনঃখনন ও খননের মাধ্যমে উন্নয়ন করে দেশীয় মাছের আবাসস্থল পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সরকার ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিগত ৫ বছরে ১০টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর অবক্ষয়িত জলাশয় মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় খনন করা হয়েছে। এসব জলাশয় উন্নয়নের ফলে বার্ষিক গড়ে প্রায় ৩০০০ টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া একটি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গোপালগঞ্জ জেলাধীন মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত মধুমতি বাঁওড়ের (দৈর্ঘ্য ৯.৩ কিমি.) আবাসস্থল পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রাচুর্যতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত তিন বছরে এ বাঁওড়ে মোট প্রায় ৬.৭৮ হেক্টর মাটি খনন করা হয়। খননকৃত জলাশয়ে দরিদ্র সুফলভোগীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীদের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া বর্নি বাঁওড়ের আবাস্থল উন্নয়নের লক্ষ্যে বিগত তিন বছরে প্রায় ১২৫ হেক্টর মাটি খনন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। উন্নয়নকৃত জলাশয়ে খাঁচায় মাছ চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। দেশব্যাপী অন্যান্য অবক্ষয়িত জলাশয়সহ ঐতিহ্যবাহী হুরা সাগর নদী পুনঃখননের মাধ্যমে মৎস্যচাষ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। উন্নয়নকৃত জলাশগুলোর সাথে সম্পৃক্ত সুফলভোগীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার।

৮. সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন মূলত আহরণ নির্ভর। উপকূলব্যাপী ৭১০ কিমি. দীর্ঘ তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের বিশাল সুযোগ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ মৎস্যসম্পদের ন্যায় সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মৎস্যজীবীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মোট ৫২,৫১৪টি যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌযানে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত প্রায় ২.৭০ লাখ মৎস্যজীবীর পরিবারের ন্যূনতম ১৩.৫০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে উপকূলীয় সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের মাধ্যমে। মৎস্য আহরণে মোট ১৮৭টি ও চিংড়ি আহরণে মোট ৩৮টি ট্রলার অর্থাৎ সর্বমোট ২২৫টি বাণিজ্যিক ট্রলার বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে মৎস্যসম্পদ আহরণে নিয়োজিত রয়েছে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারিত হওয়ায় ১,১১,৬৩১ বর্গ কিমি. এলাকায় মৎস্য আহরণে আইনগত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে নতুন নতুন মৎস্য আহরণক্ষেত্র চিহ্নিত করে তলদেশীয় ও ভাসমান মৎস্য আহরণের এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এ সম্পদ প্রত্যক্ষ জরিপের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য ফিশিং গ্রাউন্ড চিহ্নিতকরণ, মৎস্যসম্পদের প্রজাতিভিত্তিক মজুদ নিরূপণ এবং সর্বোচ্চ সহনশীল মৎস্য আহরণমাত্রা নির্ণয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের উন্নয়নের লক্ষ্যে চলমান বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের মাধ্যমে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের মজুদ নির্ণয় করে সর্বোচ্চ সহনশীল আহরণমাত্রা নির্ধারণের নিমিত্ত পেলাজিক, ডিমারসেল এবং ল্যান্ডবেইজ্ড জরিপ পরিচালনা করার লক্ষ্যে একটি গবেষণা ও জরিপ জাহাজ ক্রয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ওই প্রকল্প হতে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিবীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি কার্যক্রম জোরদারকরণের নিমিত্ত স্যাটেলাইট প্রযুক্তিনির্ভর Vessel Tracking and Monitoring System (VTMS) স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের উপকূলীয় জেলেদের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী ও মাছ ধরার সরঞ্জামসহ মোট ১১৮টি Fiber Re-enforced Plastic (FRP) নৌকা বিতরণ করা হয়েছে। এসব আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব নৌকার বিভিন্ন সুবিধা বিবেচনা করে পরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলীয় জেলেদের মধ্যে আরও অধিক সংখ্যায় নৌকা সরবরাহের বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। আইইউইউ (IUU- Illegal, Unreported and Unregulated) ফিশিংয়ের ক্ষেত্রেও মৎস্য অধিদপ্তর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে আইইউইউ ক্যাচ সার্টিফিকেটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে সামুদ্রিক মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে।

৯. মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহ : আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে তিনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার। এসব পরীক্ষাগারে LC-MS/MS মেশিনসহ ELISA, AAS I PCR মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও ঢাকার সাভারে স্থাপিত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি অত্যাধুনিক রেফারেন্স ল্যাবরেটরি কয়েক মাসের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করবে। মাছ ও চিংড়ির মাননিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান কার্যক্রমের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সনের মার্চ মাসে ইইউ মিশনের সুপারিশে মৎস্য পণ্য রপ্তানিতে আরোপিত ২০% বাধ্যতামূলক পরীক্ষা করার বিধান প্রত্যাহার করা হয়েছে। চিংড়ি সেক্টরে ট্রেসিবিলিটি সিস্টেম কার্যকর করার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই প্রায় ২.০৭ লাখ চিংড়ি খামার ও ৯,৬২৪টি রপ্তানিযোগ্য ফিনফিশের (প্রধানত পাঙ্গাস, কৈ, তেলাপিয়া ও শিং-মাগুর) খামার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। অতি সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় বাস্তবায়নাধীন একটি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ই-ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।  

বর্তমানে দেশে চিংড়ি উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সব স্তরে হ্যাসাপ ও ট্রেসিবিলিটি রেগুলেশন কার্যকর করার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৮৫ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশ আয় করেছে ৪৩১২.৬১ কোটি টাকা। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০০৩-০৪ সালে প্রায় ৫৪ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে দেশ ২৩৬৩.৪৭ কোটি টাকা আয় করে। সেখানে ১০ বছরের ব্যবধানে ২০১২-১৩ সনে রপ্তানির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ৮৫ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে এবং এ থেকে আয় প্রায় আড়াইগুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে প্রায় ৪৩১২.৬১ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ সনে ৭৭,৩২৮ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪,৭৭৬.৯৩ কোটি টাকা আয় করেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত তিনটি মৎস্য মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি অ্যাক্রিডিটেশন সনদ অর্জনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। অনেক বাধা পেরিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি সম্প্রতি রাশিয়াতে মৎস্যপণ্য রপ্তানির কারিগরি প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর হওয়ায় নতুনভাবে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সংরক্ষণ এবং বিপণনের বিষয়েও সরকার বিশেষভাবে সচেষ্ট রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর দেশের আপামর জনসাধারণের নিরাপদ মাছ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাছে ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার মাধ্যমে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মৎস্যবাজার ও আড়তগুলোতে সচেতনতা সভা করার পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করছে। মৎস্য ব্যবসায়ী, মৎস্যজীবী ও মৎস্য আড়ত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ৮০টি ফরমালিন ডিটেকটিং ডিজিটাল কিট বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি উপজেলায় এ ডিটেকটিং কিট সরবরাহ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

১০. প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ : রুই-কাতলা জাতীয় মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী, লবণাক্ত ও আধা-লবণাক্ত মাছের অন্যতম চারণক্ষেত্র (nursery ground) সুন্দরবন এবং মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ বাঁওড় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে মৎস্য অধিদপ্তর নিবিড় কর্মকা- পরিচালনা করছে। সরকার প্রাকৃতিক পোনার উৎসস্থল হালদা নদীকে রক্ষায় নানামুখী কর্মকা- বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে ২০১২ সনে বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫৬৯ কেজি রেণু আহরিত হয়েছে। ২০১৩ সালে এক ধাপে ৬২৫.৫ কেজি রেণু সংগৃহীত হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রথম ধাপে ইতোমধ্যেই ৫০৮.৩৮ কেজি রেণু সংগৃহীত হয়। আশা করা যায়, প্রতিবারের ন্যায় দ্বিতীয় ধাপেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেণু সংগৃহীত হবে। তাছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর ৭টি জেলার হাওর অঞ্চল চিহ্নিত করে ডাটাবেইজ তৈরির মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে ২০ বছরের জন্য এক উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।   

১১. মানবসম্পদ উন্নয়ন : মৎস্য সেক্টরে নিয়োজিত সব উন্নয়ন কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৩-১৪ বছরে রাজস্ব ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২.৯৭ লাখ জন সুফলভোগীকে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরে জনবল সঙ্কট এবং মৎস্য সেবা কার্যক্রমের বর্ধিত চাহিদার প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের সময়ে দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৩০০৫ জন স্থানীয় মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মী বা লিফ উন্নয়ন করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৭৫ জন মহিলা। সর্বোপরি সরকারের রূপকল্প ২০২১-এর অর্জিতব্য লক্ষ্যসমূহ অর্জনের নিমিত্ত মৎস্য অধিদপ্তরে বিদ্যমান মোট ৪৮৪৬টি রাজস্ব খাতের পদের সাথে অতিরিক্ত আরও ২৪৫৭টি পদ রাজস্ব খাতে সৃজন করার প্রস্তাব ১৯ এপ্রিল ২০১২ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। পরবর্তীতে অর্থ মন্ত্রণালয় সর্বমোট ৯২৬টি পদের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করেছে। প্রস্তাবিত জনবল কাঠামো অর্থ মন্ত্রণালয় হতে চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে মৎস্য সেক্টরের কর্মকাণ্ডে ব্যাপক গতির সঞ্চার হবে।  
 
ডিপ্লোমা-ইন-ফিশারিজ কোর্স সম্পন্ন করার মাধ্যমে মৎস্য সেক্টরে মধ্যপর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মৎস্য হ্যাচারি, মৎস্য খামার, মৎস্য খাদ্য কারখানা, মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, এনজিও ইত্যাদিতে নিয়োজিত করার লক্ষ্যে দক্ষ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় চাঁদপুরে মৎস্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতি বছর ২৫ জন করে ভর্তি করা হয় এবং বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানে সর্বমোট ১১৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। ডিসেম্বর ২০১৩-এ প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা-ইন-ফিশারিজ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ক্রমবর্ধিষ্ণু এ মৎস্য সেক্টরের মধ্যপর্যায়ে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের ব্যাপক চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় এনে বর্তমান সরকার গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ এবং সিরাজগঞ্জ জেলায় আরও তিনটি মৎস্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট স্থাপন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী চারটি মৎস্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট-এ প্রতি বছর ৪০ জন করে মোট ১৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা সম্ভব হবে।

১২. তথ্যপ্রযুক্তি সেবা প্রদান : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে মাছ ও চিংড়ি চাষিদের চাহিদাভিত্তিক প্রযুক্তি সেবা তাৎক্ষণিকভাবে প্রদানের লক্ষ্যে দেশের ১০টি জেলার ১০টি উপজেলার ১০টি গ্রামে ই-এক্সটেনশন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে ৭০০টি চাষি পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক) ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্মিত হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মহাসড়কে গ্রামীণ চাষিদের সম্পৃক্তকরণ বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দেশব্যাপী মৎস্যজীবী-জেলেদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদানের নিমিত্ত ডাটাবেজ তৈরির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করা যায়, এ কর্মসূচি দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাক্সিক্ষত অবদান রাখার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে অধিকতর সামর্থ্যবান করে তুলবে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

উপসংহার : চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ, খাস জলাশয়গুলো জৈবিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনয়ন, আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চাষ পদ্ধতি নিবিড়করণ ও বহুমুখীকরণ, সব ধরনের জলজ সম্পদ ও তথ্যপ্রযুক্তি কার্যকরভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন আগামী ২০১৪-১৫ সন নাগাদ ৩৭.০৩ লাখ টন এবং ২০২০-২১ সন নাগাদ ৪৫.৫২ লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এর ফলে মাছ ও চিংড়িসহ অন্যান্য জলজ সম্পদের দায়িত্বশীল উৎপাদন নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশীয় খাদ্য নিরাপত্তা বিধান, আপামর জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তি নির্ভর, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য অধিদপ্তর তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
 
তথ্যসূত্র:

  1. সৈয়দ আরিফ আজাদ (১৪২২ক) বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা, কৃষিকথা, বৈশাখ, ১৪২২, কৃষি তথ্য সার্ভিস। ওয়েব: http://www.ais.gov.bd
  2. সৈয়দ আরিফ আজাদ (১৪২২খ) বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা (দ্বিতীয় পর্ব), কৃষিকথা, জ্যৈষ্ঠ, ১৪২২, কৃষি তথ্য সার্ভিস। ওয়েব: http://www.ais.gov.bd
Answer for বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা কি?