পাঙ্গাস মাছের উন্নত নার্সারী ব্যবস্থাপনা
পাঙ্গাস নার্সারীর উপযোগীতা
- সুস্থ সবল পোনা অধিক মৎস্য উৎপাদন নিশ্চিত করে ।
- চাহিদা মত ও সময় মত পোনা প্রাপ্তির জন্য ।
- রেণু পোনার মৃত্যুর হার কমানোর জন্য ।
- মৌসুমী জলাশয়ের সদব্যবহার ।
নার্সারী ব্যবস্থাপনা
নার্সারী ব্যবস্থাপনাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় – মজুদপূর্ব, মজুদকালীন ও মজুদপরবর্তী। নার্সারী ব্যবস্থাপনার বিবেচ্য বিষয়গুলি নিম্নরুপ –
- পুকুর নির্বাচন
- পুকুর শুকানো
- চুন প্রয়োগ
- সার প্রয়োগ
- কীট পতঙ্গ দমন
- পোনা মজুদকরণ
- পরিচর্যা
- আহরণ
- আগাছা পরিষ্কার ও রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত প্রাণী দূর করতে হবে ।
পাঙ্গাসের রেণু পোনা প্রতিপালন পদ্ধতি
- এক ধাপ প্রতিপালন পদ্ধতি – ১৫-২০ গ্রাম রেণু/ শতাংশ
- দুই ধাপ প্রতিপালন পদ্ধতি – ৭৫- ১৫০ গ্রাম রেণু/ শতাংশ (১৫- ২০ দিনের মধ্যেই কাটাই করে ৪০০০-৫০০০ ধানী পোনা প্রতি শতাংশে দিতে হবে, ৩৫ – ৫০ দিনের মধ্যেই ২”- ৪” সাইজের পোনা পাওয়া যাবে।
নার্সারী পুকুর নির্বাচন
- মৌসুমে অথবা সারা বছর পানি থাকে ।
- আয়তনে ছোট ও আয়তাকার ।
- আয়তনে ৩০-৫০ শতাংশ উত্তম।
- গভীরতা ৩-৪ ফুট ভাল ।
- পানি সরবরাহ ও বের করার উত্তম ব্যবস্থা ।
- পুকুর পাড়ে গাছ না থাকা উত্তম । গাছ থাকলে পাতা ঝরে পুকুরের পানি নষ্ট করে দেয় ।
- সূর্যালোক না পৌঁছলে প্রাকৃতিক খাবার জন্ম ব্যহত হবে।
পুকুর শুকানো
- উত্তম এবং জরুরী ।
- পাড় মেরামত ও তলার আগাছা পরিষ্কার করণ ।
- রাুসে ও অবাঞ্ছিত প্রাণী নির্মুল ।
- তিকারক পোকা মাকড়, পরজীবি রোদে শুকিয়ে মারা যাবে ।
- তলার আবর্জনা রোদে শুকালে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে ।
নার্সারী পুকুরের চারপাশে নেটের বেড়া স্থাপন
জলজ আগাছা পরিষ্কার ও রাুসে ও অবাঞ্ছিত প্রাণী নির্মুলের পর বাজারে প্রচলিত সস্তা মিহি ফাঁসের নাইলনের নেট দ্বারা পুকুরের চারপাশে পানির কিনার ঘেষে ২ ফুট উঁচু করে বেড়া দিলে তিকারক পোকামাকড়, সাপ, ব্যাং, কাঁকড়া, হাঁসপোকা ইত্যাদির হাত থেকে পোনামাছ রা পাবে এবং পোনামাছ বাঁচার হার বেড়ে যাবে।
পুকুের চুন প্রয়োগ
- চুনের এমন গুন যেন ভাতের সাথে নুন ।
- pH সমতা রাখে ।
- পুকুরের প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সক্রিয় করার জন্য চুন CO2 এর সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম বাইকার্বনেট তৈরী করে যা পানিতে সালোকসংশ্লেষন প্রক্রিয়া চালু রাখে।
- চুন পুকুরের তলদেশের জৈব ও বর্জ্য পদার্থকে পচাতে সাহায্য করে ফলে নাইট্রোজেনের পরিমান বেড়ে যায় যা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনতে প্রভাবিত করে।
- মাটির পুষ্টিকারক পদার্থ পানিতে মিশিয়ে মাছের খাবার তৈরীতে সাহায্য করে।
- চুন প্রয়োগে তলদেশের পরজীবি ও তিকারক অনুজীব ধংস হয় ।
- পানির ঘোলাত্ব দুরীকরণ ও পানি পরিশোধনের কাজ করে।
চুনের প্রকারভেদ ও প্রয়োগ মাত্রা
চুনের প্রধান উপাদান হলো ক্যালসিয়াম। বাজারে প্রচলিত চুন নিম্নরূপে পাওয়া যায়, যেমন- পোড়া চুন (CaO), পাথুরে চুন (CaCO3), কলিচুন (Ca(OH)2), জিপসাম (CaSO4, 2H2O), ডলোমাইট (CaMg(CO3)2)। পুকুর শুকিয়ে বা পানিতে সাধারনত শতাংশে ১ কেজি হারে পাথর চুন দেওয়া হয় তবে চুনের প্রয়োগ মাত্রা pHএর উপর নির্ভরশীল, যেমন-
pH-এর মান পাথুরে চুন (কেজি/শতাংশ)
৩ – ৫ এর মধ্যে ১২
৫ – ৬ এর মধ্যে ৮
৬ – ৭ এর মধ্যে ৪
- পানির pH ৭ এর কম হলে পাথুরে চুন এবং ডলোমাইট এবং pH ৭ এর বেশী হলে জিপসাম ব্যবহার করা ভাল। জিপসাম কাদাজনিত ঘোলাত্ব কমাতে অধিক ফলপ্রসূ।
পুকুরে সার প্রয়োগ
- পাকৃতিক খাদ্য (সবুজ রং phytoplankton আর বাদামী রং zooplankton-এর আধিক্য) উৎপাদনের জন্য পুকুরে জৈব ও অজৈব সার দিতে হবে।
- জৈব সার – গোবর ৫-১০ কেজি/শতাংশ
- অজৈব সার – ইউরিয়া ১০০ গ্রাম/শতাংশ ও টিএসপি ২০০ গ্রাম/শতাংশ
পাঙ্গাস নার্সারীতে চুন ও সার প্রয়োগের নিয়মাবলী
পরিমিত পরিমান চুন পানিতে ভিজিয়ে ছেঁকে নিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে এবং ভাল করে মই দিয়ে তলা সমান করে নিতে হবে। চুন প্রয়োগের ১ দিন পর পরিমিত পরিমান গোবর পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে । একই দিন পরিমিত পরিমান অজৈব সার পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে । এসময় শতাংশ প্রতি ২০০ গ্রাম ভিজা খৈল ব্যবহার করা যেতে পারে।
নার্সারী পুকুরে পানি ঢুকানো
- পাঙ্গাস নার্সারীতে কোন অবস্থাতেই যেন রাুসে বা অবাঞ্ছিত মাছ না ঢুকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে
- পানির গভীরতা ৩-৪ ফুেটর মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
- সাধারন হিসাবে হ্যাচারীতে পাঙ্গাসের ড়িম দেখে পুকুরে পানি ঢুকাতে হয়। পুকরে খুব বেশী এবং বড় আকারের প্লাংক্টন (যেটা রেণুর জন্য তির কারন) যাতে না জন্মাতে পারে সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই পুকুরে পানি ঢুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে ।
জলজ কীট পতঙ্গ দমন
- চুন ও সার প্রয়োগের ফলে পুকুরে পাংক্টন সমৃদ্ধ হওয়ায় হাঁসপোকা ও ব্যাঙাচি জন্ম নিবে । এরা পোনা ও পুকুরের খাবার খেয়ে ফেলে ও পোনার লেজ কেটে ফেলে ।
- রেণু ছাড়ার ১২-১৫ ঘন্টা আগেই হাঁসপোকা দমন করতেই হবে
হাঁসপোকা দমনের উপায়
- ডিপটেরাক্স (দানাদার রাসায়নিক) – মাত্রা ০.৫-১ পিপিএম বা ২০ গ্রাম/শতাংশ/২-৩ ফুট পানির জন্য।
- সুমিথিওন/ লিথিওন (তরল রাসায়নিক) – মাত্রা ১০ মিলি লিটার/শতাংশ/২-৩ ফুট পানির জন্য।
- রাসায়নিক প্রয়োগের ১২-১৫ ঘন্টার মধ্যেই রেণু পোনা ছাড়া যাবে ।
রেণু মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা
বিবেচ্য বিষয়
- রেণুর উৎস্য
- উন্নত জাত নিশ্চিতকরন
- অন্তঃপ্রজনন সমস্যা মুক্ত রেণু
- রেণু পরিবহন
- টেকসই করণ
- রেণু ছাড়া
পাঙ্গাসের রেণু মজুদের সময় করণীয়
- সুমিথিয়ন প্রয়োগের ৪/৫ ঘন্টা পর শতাংশে ২০০ গ্রাম করে ময়দা পানিতে মিশিয়ে সারা পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। ডিম থেকে হ্যাচিং এর পর ৩৬-৪৪ ঘন্টার মধ্যে রেণুপোনা পুকুরে ছাড়তে হবে। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে পাঙ্গাসের রেণু প্রথম খাবারের সময় হলেই যদি খাবার না পায় তবে একটা আরেকটাকে কামড়াতে থাকে। তাই কামড়ানো শুরু করার পূর্বেই পুকুরে ছাড়তে হবে।
- রেণুপোনা অত্যন্ত কোমল তাই ছাড়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- পানির তাপমাত্রা ও অক্সিজেন বিবেচ্য বিষয়
- সূর্যোদয়ের পর সকাল বেলা ও সূর্যাস্তের পর পোনা ছাড়া উত্তম
- পলিব্যাগ চটের ব্যাগ থেকে বের করে পুকুরের পানিতে রাখতে হবে
- তারপর আস্তে আস্তে মুখ খুলতে হবে
- ব্যাগের ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা সমতার জন্য আস্তে আস্তে পুকুরের পানি ব্যাগে দিতে হবে। আর তাপমাত্রা পরীা করতে হবে।
- তাপমাত্রা সমতায় এলে ব্যাগ কাত করে ধরলে পোনা আপনা আপনিই পুকুরের দিকে যাবে।সারা পুকুরে রেণুপোনা ছড়িয়ে দেওয়াই ভালো।
রেণু মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
রেণুর খাবার
- রেণূ ছাড়ার ১ ঘন্টা পর শতাংশে ১০০ গ্রাম ময়দা + ১০০ গ্রাম গুড়োদুধ + ৫টি স্যালাইন পানিতে গুলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
- ১-৩ দিন – শতাংশে ১০০ গ্রাম ময়দা +১০০ গ্রাম গুড়োদুধ + ১ টি সিদ্ধ ডিমের কুসুম পানিতে গুলে ছিটিয়ে দিতে হবে (৮ ঘন্টা পরপর)। প্রতিবার খাবার দেয়ার সময় গামছা বা হাপা দিয়ে রেণু চেক করতে হবে।
- ৪-৫ দিন থেকে ৭৫% ময়দা + ২৫% ভুট্টার বেসন (১০০% দৈহিক ওজন) এর সাথে (প্রতি কেজি খাবারে ৮টি সিদ্ধ ডিম + ৩ টি রেনামাইসিন ক্যাপসুল) সকাল ও বিকালে সমপরিমান প্রয়োগ করতে হবে।
- ১০-১৫ দিন থেকে ৪০-৪৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ পিলেট খাবার খৈলের পানিতে ভিজিয়ে (২০০% দৈহিক ওজন) সকাল ও বিকালে সমপরিমান প্রয়োগ করতে হবে।
- ১৫-২০ দিন থেকে ৪০-৪৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ পিলেট খাবার (৩০০% দৈহিক ওজন) সকাল ও বিকালে সমপরিমান প্রয়োগ করতে হবে।
- ২০ দিনের মধ্যেই পোনা কাটাই করে অন্য পুকুরে দিতে হবে। ঐ পুকুরটিও ভালভাবে তৈরী করে নিতে হবে।
- রেণুপোনা কাটাই করে অন্য পুকুরে স্থানান্তরের পর থেকে-
- ১ম সপ্তাহে দৈহিক ওজনের ৩৫-৩০%
- ২য় সপ্তাহে দৈহিক ওজনের ২৫-২০%
- ৩য় সপ্তাহে দৈহিক ওজনের ১৫-১০%
- এভাবে চলবে———
রেণুপোনার পরিচর্যা
- পানিতে খাবার ও সার দেওয়ায় ফলে পাড়ে ঘাস জন্মে, এগুলিপরিষ্কার করতে হবে ।
- ব্যাঙ, সাপ, গুইসাপ প্রবেশে বাধা দেয়া ।
- অক্সিজেন কমে মাছ ভেসে উঠলে জলচর পাখি থেকে পোনা রা করা ।
- কোন ময়লা না ফেলা ।
- পুকুরে খাবার দেযার পর অবশিষ্টাংশ পরীা করে খাবার কমানো-বাড়ানো ।
- অধিক প্লাক্টন ব্লুম হলে খাবার বন্ধ ও পানির আয়তন বাড়াতে হবে।
- পোনা ছাড়ার ০৭ দিন পর থেকে সূর্য উঠার পর ও বিকালে ১-২ বার হরা টানা । এর ফলে তলার দুষিত গ্যাস বের হয়ে যাবে ও শ্যাওলা জন্ম নিতে পারবেনা ।
- ১ কেজি রেণু থেকে ৪- ৫ লাখ পাংগাসের পোনা পাওয়া যায় তবে এটি নির্ভর করে রেণু পোনা মাপের উপর ও সঠিক ব্যবস্থাপনার উপর ।
তথ্যসূত্র:
ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেন, ড. মোঃ শাহাআলী, ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, ড. মোঃ আব্দুল ওহাব এবং ড. মোঃ সাইফুদ্দিন শাহ্ (২০১১) থাই পাংগাস মাছের পোনা উৎপাদনে হ্যাচারী ও চাষ ব্যবস্থাপনা: প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল। বাংলাদেশ ফিসারিজ রিসার্চ ফোরাম, ইনোভিশন কনসালটিং প্রাইভেট লিমিটেড এবং ক্যাটালিষ্ট। পাতা ৮-১৩।