জীববৈচিত্র্য হ্রাসের কারণ
মানবসৃষ্ট ও পরিবেশগত নানাবিধ কারণে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ছোট মাছের প্রাচুর্য্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে তথা জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। ছোট মাছের জীববৈচিত্র্য হ্রাসে নিম্নোক্ত কারণগুলো উল্লেখযোগ্য।
১। মাছের অধিক আহরণ
মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে স্বাভাবিকভাবে মুক্ত জলাশয়ে ছোট মাছ আহরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে একদিকে জলাশয়ে মাছের মজুদ হ্রাস পাওয়ায় জলাশয়গুলোতে মাছের আশানুরুপ উৎপাদন হচ্ছে না।
২। অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, স্লুইচ গেট, রাস্তা, সেচ অবকাঠামো ও কালভার্ট নির্মাণ
মৎস্যসম্পদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় না এনে অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, স্লুইচ গেইট, সেচ নালা, রাস্তা ও কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণের ফলে প্লাবনভূমির আয়তন এবং পানি অবস্থানের সময় কমে যাচ্ছে এবং মাছের প্রজনন ক্ষেত্রসমূহ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া যে সকল বিলে সারা বছর পানি থাকত সেগুলো এখন মৌসুমী জলাতে পরিণত হওয়ায় তাতে ডিমওয়ালা মাছ নিয়মিত প্রজনন করতে পারছে না। উপরন্তু অপরিকল্পিত এসব অবকাঠামো নির্মাণের ফলে নদীর সঙ্গে বিলের বা বিলের সঙ্গে নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মাছের প্রজনন অভিপ্রয়ান (Breeding migration) সীমিত হয়ে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্থ হওয়ায় সার্বিক উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
৩। কৃষি ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ও নিষিদ্ধ কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার
বর্তমানে কৃষিকাজে বিশেষ করে উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। ছোট মাছ তথা মাছ চাষের উপর কীটনাশকের বহুমাত্রিক ক্ষতিকর প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে। কীটনাশকের প্রভাবে পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলীর হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায়। ফলে জলজ পরিবেশের ভারসাম্য ও গুণাবলী নষ্ট হয়। কীটনাশক দ্বারা জলজ পরিবেশ দূষিত হলে যে সকল প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নরূপঃ
- জলজ পরিবেশে বসবাসরত জীবের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের আদান-প্রদান ব্যাহত হয়।
- দূষিত পরিবেশে মাছসহ অন্যান্য জলজ জীবের অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা ২-৩ গুণ বৃদ্ধি পায়।
- পানির তাপমাত্রা ও পিএইচ বৃদ্ধি পেলে পানিতে অর্গানোফসফরাস জাতীয় কীটনাশকের কার্যকারিতা ৩-৪ গুন বৃদ্ধি পায়।
- প্রতিটি ভৌত-রাসায়নিক পরিবর্তনই মাছের বাঁচার হার, বৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষমতা সংরক্ষণের সাথে সম্পর্কিত। এ ধরণের পরিবর্তন পানির উৎপাদনশীলতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে থাকে।
- মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য ধ্বংস এবং খাদ্য শিকল বিনষ্ট করে।
- মাছের সরাসরি মৃত্যু ঘটায়।
- মাছের ও অন্যান্য জলজ জীবের শারীরবৃত্ত্বীয় পরিবর্তন ঘটে।
- প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্রের পরিবর্তন হয়।
- মাছের রোগ-বালাই বৃদ্ধি পায়।
৪। মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস/হ্রাস
বিভিন্ন ধরণের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড যেমন- বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, অপরিকল্পিত রাস্তা ও সেচ খাল নির্মাণ, যত্রতত্র নদ-নদী ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে মাছের আবাসস্থলের সংকোচনের ফলে মাছ তথা ছোট মাছের প্রজনন বিঘ্নিত হচ্ছে এবং উৎপাদন ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। অধিকন্তু এসব মাছের প্রকৃত আবাসস্থল তথা প্রাকৃতিক জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রের (Ecosystem) মারাত্মক পরিবর্তন সাধন যেমন- জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া, জলাশয় সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে ফেলার ফলে Benthos ও অন্যান্য জীবের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় ছোট মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
৫। প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ নিধন
প্রজনন মৌসুমে কারেন্ট জালসহ অন্যান্য অননুমোদিত ক্ষতিকর জাল ও ফাঁদের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন মুক্ত জলাশয় থেকে ডিমওয়ালা ছোট মাছ প্রতিনিয়ত নিধনের ফলে মুক্ত জলাশয়ে ছোট মাছের প্রজনন মারাত্নকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
৬। কল-কারখানার বর্জ্যের মাধ্যমে পানি দূষণ
ক্রমাগত শিল্পায়নের ফলে কল-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য প্রতিনিয়ত নির্গত হওয়ায় এর বিষক্রিয়ায় মুক্ত জলাশয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ফলে ব্যাপকভাবে মাছ রোগাক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে।
৭। নদী ও অন্যান্য মুক্ত জলাশয়ে পলি জমা
খাল-বিল ও নদ-নদীতে ব্যাপকহারে পলি জমার ফলে একদিকে যেমন তাদের উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে হাওর-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা হ্রাস পেয়ে পর্যায়ক্রমে সেগুলো ধানক্ষেতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন নদ-নদী ড্রেজিং না করায় এবং বিভিন্ন বাঁধের কারণে শুকনো মৌসুমে প্রায় সব নদী শুকিয়ে নদ-নদীতে পানির প্রবাহ কমে যায়। তাছাড়া ক্রমাগত নদী ভাঙ্গন এবং বন উজারের ফলে পলি জমার পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় ছোট মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে।
৮। খাল-বিল ভরাট করে জনপদ গড়ে উঠা
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল-বিল ভরাট করে নতুন করে বসতবাড়ী ও শিল্প কারখানা নির্মিত হচ্ছে। এতে জলাশয়ের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
৯। জলাভূমিকে কৃষি ভূমিতে রূপান্তর
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বর্ধিত জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা মেটাতে জলাভূমিগুলোকে ক্রমাগত কৃষি জমিতে রূপান্তর করা হচ্ছে।
১০। প্লাবন ভূমির Ecosystem পরিবর্তন
জলাভূমির অবক্ষয় যেমন- সেচ কার্যক্রম, পলি জমাট, কল-কারখানা হতে নির্গত বর্জ্য, অতি আহরণ, ডিমওয়ালা মাছ নিধণ, প্রজনন ক্ষেত্রের পরিবর্তন ও হ্রাস, পানি প্রবাহের দিক পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্লাবনভূমির বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) ধ্বংস হচ্ছে।
১১। পানি শুকিয়ে বা সেচে মাছ আহরণ
সাধারণত শুকনো মৌসুমে ডিমওয়ালা ছোট মাছগুলো পরবর্তী প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় ছোট ছোট জলাশয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু সেচ কাজে অথবা মাছ ধরার জন্য এসব জলাশয়গুলো সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ফেলায় ডিমওয়ালা ছোট মাছ ও তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় বংশ বৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্থ হয়।
১২। কৃষি জমিতে অতিমাত্রায় সেচ
উচ্চ ফলনশীল ধান ও অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-গর্ভস্থ পানি অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে যেমন ভূ-পৃষ্ঠস্থ জলাশয়সমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে তেমন ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে জলাশয়সমূহে কাংখিত মাত্রায় পানি না থাকায় ছোট মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে।
১৩। বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে কাঙ্খিত চাষ ব্যবস্থাপনায় রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণ
কার্প ও অন্যান্য মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর প্রস্ত্ততির অংশ হিসাবে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণের নিমিত্তে বিষ প্রয়োগ করা হয়। ফলে ঐ জলাশয়ের ছোট মাছ সমূহ সম্পূর্ণভাবে নিধন হয়ে যায় এবং বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
১৪। কারেন্ট জালসহ অন্যান্য অননুমোদিত ক্ষতিকর জাল ও ফাঁদের ব্যাপক ব্যবহার
অবৈধ কারেন্ট জালসহ অন্যান্য অননুমোদিত জাল (যেমন- বেহুন্দি জাল, মশারী জাল, ভেসাল জাল ইত্যাদি) ও ফাঁদ ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন জলাশয় থেকে নির্বিচারে ডিমওয়ালা ছোট মাছ ও পোনা নিধন করা হচ্ছে।
১৫। মাছের রোগ
১৯৮৮ সাল থেকে ছোট মাছ বিশেষ করে দেশীয় পুঁটি ও টাকি মাছ ব্যাপকভাবে ক্ষতরোগে আক্রান্ত হয়। ফলে এ দু’টি প্রজাতিসহ অন্যান্য কিছু ছোট মাছের প্রাচুর্যতা কমে যায়।
১৬। বিদেশী প্রজাতির মাছের প্রভাব
অতিমাত্রায় বিদেশী মাছের চাষ সম্প্রসারণের ফলে দেশীয় ছোট মাছের জীববৈচিত্র ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় ছোট মাছের বিস্তার হুমকীর সম্মুখীন।
১৭। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাংশে পানির অভাব
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব বিশেষ করে উত্তর পশ্চিমাংশে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করায় প্রতিনিয়ত জলাভূমির পরিবর্তন হচ্ছে। উত্তর পশ্চিমাংশে ক্রমাগত মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে নদ-নদীসহ অন্যান্য জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় মৎস্যকুল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র: DoF, Bangladesh