১. থাই কৈ মাছ চাষের ইতিহাস ও গুরুত্ব
আবহমান কাল হতে বাংলাদেশে কৈ অত্যন্ত অভিজাত ও জনপ্রিয় মাছ হিসেবে পরিচিত। এ মাছ খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। কিন্তু প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশ বিপর্যয় এবং অত্যধিক আহরণের কারণে এ মাছটি আজ বিলুপ্তির পথে।
বেসরকারী পর্যায়ে ২০০২ সালে কৈ মাছের একটি বর্ধনশীল জাত-থাই কৈ বাংলাদেশে আমদানী করা হয়। এ মাছটি দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় এর উৎপাদন দেশী কৈ অপো ৫০% বেশী বিধায় মৎস্য চাষে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। মাছটির প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কলাকৌশল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে এবং যথেষ্ট সাফল্য পাওয়া গেছে। উলে-খ্য যে, এ মাছের চাষ অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় ইতোমধ্যেই ময়মনসিংহ সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাষীদের মাঝে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
অধিকন্তু কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এ মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি সহজতর বিধায় ইতোমধ্যে অনেক হ্যাচারীও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৯ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট পুনরায় থাইল্যান্ড থেকে কৈ মাছের উন্নত জার্মপ্লাজম (১০০০ টি) আমদানী করে। উক্ত আমদানীকৃত স্টক থেকে ২০০ টি কৈ মাছের পোনা মৎস্য অধিদপ্তরের নান্দাইলস্থ মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে সরবরাহ করা হয় এবং অবশিষ্ট ৮০০ টি জার্মপ্লাজম ইনষ্টিটিউটের গবেষণা পুকুরে প্রতিপালন করে ব্রুড তৈরী করা হয়। ইনষ্টিটিউটে এই  কৈ  মাছ  থেকে Broodstock replacement techniques-এর মাধ্যমে উৎপাদিত উন্নত জাতের ৫০ হাজার পোনা ব্যাপক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে হ্যাচারী মালিকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। গবেষণা পর্যবেণে দেখা গেছে যে, নতুন আমাদানীকৃত এই থাই কৈ মাছ বর্তমানে আমাদের দেশে চাষকৃত থাই কৈ এর চেয়ে প্রায় ৪০-৪৫% বেশী উৎপাদনশীল।

১.১ কৈ মাছের গুরুত্ব

  • কৈ মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর।
  • স্বল্প গভীরতা সম্পন্ন পুকুরে এ মাছের চাষ করা হয়।
  • অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়।
  • অন্যান্য মাছের তুলনায় চাহিদা ও বাজার মূল্য অধিক।
  • কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ব্যাপক পোনা উৎপাদন সম্ভব।
  • রোগীর পথ্য হিসেবে এ মাছ অত্যন্ত সমাদৃত।

২. কৈ মাছের জীবন বৃত্তান্ত
২.১ আবাসস্থল
কৈ মাছ সাধারণত খাল, বিল, প্লাবনভূমি, হাওড়-বাওড়, পুকুর, দিঘী, ডোবা-নালা এবং নিমজ্জিত ধান ও তৃণক্ষেতে দেখতে পাওয়া যায়। এরা কর্দমাক্ত তলার মাটিতে, গর্তে, নিমজ্জিত গাছের গুড়ির তলায় বা সুড়ঙ্গে বসবাস করতে পছন্দ করে। স্রোতহীন আবদ্ধ পানিতে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। কৈ মাছ আগাছা, দল, কচুরিপানা, পচা পাতা, ডাল-পালা অধ্যুষিত জলাশয়ে, হাওড়-বাওড়, পুকুর, বিল, দীঘি, ডোবা, খাল, নালা ও নিমজ্জিত ধানেেত বসবাস করে থাকে।

২.২ খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস
কৈ মাছের খাদ্যাভ্যাস অনেকটা শিং-মাগুর মাছের মতোই, অর্থাৎ-রেণু পর্যায়-জুওপ্লাংকটন ও ক্ষুদ্র জলজ পোকা-মাকড় ইত্যাদি আকর্ষণীয় খাদ্য। জুভেনাইল পর্যায়-জুওপ্লাংকটন, ক্ষুদ্র জলজ পোকা ও টিউবিফিসিড ওয়ার্ম। বয়োপ্রাপ্ত অবস্থায়-জলজ পোকা-মাকড়, বেনথোস, টিউবিফিসিড ওয়ার্ম, ক্ষুদ্র চিংড়ি মাছ, ডেট্রিটাস ও পচনশীল প্রাণিজ দ্রব্যাদি।

২.৩ পরিপক্কতা
প্রথমে বছরেই পরিপক্কতা লাভ করে। কৈ মাছ বছরে একবার প্রজনন করে থাকে। প্রজনন কাল মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস। এপ্রিল থেকে মে মাসে সর্বোচ্চ প্রজনন সম্পন্ন হয়।

২.৪ ডিম ধারণ মতা ও ডিমের ধরণ

  • কৈ মাছের ডিম ধারণ মতা শিং-মাগুর মাছের মতোই যা স্ত্রী মাছের ওজ নের ওপর নির্ভর করে।
  • তবে স্ত্রী ও পুরুষ কৈ মাছ আকারে সমান হয় না। সাধারণত স্ত্রী মাছ পুরুষের চেয়ে বড় হয়।
  • ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের কৈ মাছের ডিম ধারণ মতা ৬,০০০-৮,০০০ এর ম ধ্যে হয়ে থাকে।
  • পরিপক্ক ডিমগুলো হালকা বাদামী থেকে তামাটে বর্ণের হয়।
  • কৈ মাছের নিষিক্ত ডিমের আবরণ অন্যান্য মাছের ডিম থেকে ভিন্ন এবং আদ্রতা হ্রাস বা আংশিক শুকিয়ে গেলেও ডিমের অভ্যন্তরে
  • ভ্রুণের মৃত্যু ঘটে না।

২.৫ স্ত্রী-পুরুষ অনুপাত
কৈ মাছের সুনির্দিষ্ট লিঙ্গ অনুপাত সম্পর্কিত উপাত্ত পাওয়া যায় নাই । তবে ধারণা করা হয়, এ অনুপাত ১ ঃ ১ বা এর কাছাকাছি ।

২.৬ প্রজনন এলাকা
কৈ মাছ সাধারণত খাল-বিল, প-াবনভূমি, ডোবা-নালা এবং নিমজ্জিত ধান ও তৃণক্ষেতে যেখানে বর্ষার প্রথমে বৃষ্টির পানি জমে ঐ সকল স্থানে প্রজনন কাজ সম্পন্ন করে। প্রাকৃতিক উৎস্যের কৈ মাছ বর্ষার প্রথম মেঘ গর্জনের সময় আবাসস্থলের জলাশয়ের ঢালু পাড় বেয়ে উঠে আসে এবং বর্ষার পানিতে নিমজ্জিত জলাশয়ে ডিম দেয়।

৩. কৈ মাছের উন্নত জাতের ব্রুড উৎপাদন কৌশল প্রোটোকল

  • উন্নতজাতের ব্রুড উৎপাদন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ৫০ টি হাপার প্রয়োজন হয়
  • প্রতি ব্যাচে ১০টি হাপা তে প্রজনন করা হয় এবং এভাবে মোট ৫টি ব্যাচের মাধ্যমে এই কার্যক্রম সম্পন্ন হয়
  • প্রতি হাপাতে ৫ টি পুরুষ ও ৫ টি স্ত্রী ব্রুড মাছকে কৃত্রিম প্রজনন করা হয়
  • প্রতি ব্যাচে প্রতিটি হাপা থেকে ২০ গ্রাম করে মোট ২০০ গ্রাম রেণু একত্রিত করতে হয়
  • এই ২০০ গ্রাম রেণু একটি নার্সারী পুকুরে ৪-৬ সপ্তাহ পালন করতে হয়
  • একই পদ্ধতিতে ৫টি নার্সারী পুকুরে রেণু লালন করতে হয়
  • নার্সারী পুকুরে লালনের পর প্রতিটি নার্সারী পুকুর থেকে ৫০০টি পোনা নির্বাচন করে একটি পুকুরে পালন করতে হয় (৫০০x৫= ২,৫০০)।
  • চার থেকে পাঁচ মাস পালনের পর এই পোনাগুলো উন্নতজাতের ব্রুড মাছে রূপান্তরিত হবে এবং এই ব্রুড পরবর্তীতে পোনা উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়।

৪. কৈ মাছের ব্রুড ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন

৪.১ পুকুর নির্বাচন
প্রজননম  কৈ  মাছ  প্রতিপালনের  জন্য  পুকুর  নির্বাচন  একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ মাছ চাষের জন্য ৬-৭ মাস পানি থাকে এ রকম ২০-৫০ শতাংশের পুকুর নির্বাচন করতে হবে। তবে এর চেয়ে বড় পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায়।

৪.২ পুকুর প্রস্তুতি
পুকুরের পাড় মেরামত ও জলজ আগাছা পরিস্কার করতে হবে। প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ আবশ্যক। চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর প্রজননম কৈ মাছ মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪.৩ প্রজননম কৈ মাছ মজুদ
পোনা উৎপাদনের জন্য অক্টোবর মাসে ভালো জাতের সুস্থ-সবল ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের কৈ মাছ প্রতি শতাংশে ১০০-১২০ টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।

৪.৪ সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ
সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ফিশমিল ৩০%, মিট ও বোন মিল ১০%, সরিষার খৈল ১৫%, সয়াবিন খৈল ২০%. চালের কুড়া ২০%, আটা ৪%, ভিটামিন ও খনিজ লবণ ১% এর মিশ্রণ মাছের দেহের ওজনের ৩-৪% হারে প্রতি দিন ২ বার সরবরাহ করতে হবে। নভেম্বর-জানুয়ারী মাসে ২% হারে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। কৈ মাছের ব্রুডের জন্য ভাসমান বাণিজ্যিক খাবার ব্যবহারে সবচেয়ে ভাল  ফল পাওয়া যায়। কৈ মাছের খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের পরিমাণ বেশী হওয়া বাঞ্ছনীয়।

৪.৫ ব্যবস্থাপনা
নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। প্রতি সপ্তাহে পানির াগুন যেমন পানির তাপমাত্রা, অক্সিজেন, পিএইচ, মোট ক্ষারকত্ব ইত্যাদি নির্ণয় করা বশ্যক। দুই সপ্তাহ পর পর পুকুরে প্রতি শতাংশে ২০০-৩০০ গ্রাম কলিচুন পানিতে শয়ে প্রয়োগ করতে হবে। শীত মৌসুমে পুকুরে জাল না টানাই ভাল।

৪.৬ প্রজননম স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সনাক্তকরণ
নন ঋতু ছাড়া কৈ মাছের স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সনাক্ত করা কষ্টকর। তবে প্রজনন মৌসুমে ত সহজেই এদেরকে সনাক্ত করা যায়। নিম্নে স্ত্রী ও পুরুষ মাছের বৈশিষ্ট উল্লেখ করা হলো।
স্ত্রী মাছ

  • পেট বেশ ফোলা ও নরম।
  • পটে আস্তে চাপ দিলে অল্প ডিম বেরিয়ে আসে।
  • পেটে হালকাভাবে চাপ দিলে জননাঙ্গে স্ফীতি লক্ষ্য করা যায়।
  • স্ত্রী মাছের তুলনায় পুরুষ মাছ ছোট হয়ে থাকে।

পুরুষ মাছ

  • বক্ষপাখনা ও শ্রেণী পাখনাতে লাল বর্ণ দেখা যায়।
  • পেটে হালকা চাপ দিলে শুক্রানু বেরিয়ে আসে।
  • পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছের তুলনায় ছোট হয়ে থাকে।

৪.৭ কৃত্রিম প্রজনন কৌশল

  • মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর কৈ মাছের প্রজনন কাল।
  • পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকে ১টি করে পিটুইটারী ইনজেকশন দিতে হয়।   ইনজেকশনের মাত্রা স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে ৮-১০ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি দৈহিক ওজন।
  • পুরুষ মাছের ক্ষেত্রে এমাত্রা হবে ৪ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি দৈহিক ওজন।
  • পিটুইটারী দ্রবণের ইনজেকশন পেক্টোরাল পাখনার নিম্নাংশে দিতে হবে।
  • ইনজেকশন দেয়ার পর পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে ১ঃ১ অনুপাতে হাপায় রেখে পানির কৃত্রিম ঝর্ণা প্রবাহ দিতে হয়।
  • সাধারণত ইনজেকশন প্রদানের ৮-৯ ঘন্টা পর মাছ ডিম দেয়।
  • ডিম হালকা ক্রিম রংয়ের হয়ে থাকে।
  • ডিম ছাড়ার পর যত দ্রুত সম্ভব ব্রুড মাছগুলোকে সর্তকতার সাথে হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
  • তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে ২০-২২ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণুপোনা বের এবং পরবর্তী ২-৩ দিন হাপাতেই রাখতে হয়।
  • ডিম ফোটার ৬০ ঘন্টা পর্যন্ত রেণুপোনা কুসুমথলি থেকে পুষ্টি গ্রহন করে।
  • ৬০ ঘন্টা পর রেণুপোনাকে খাবার হিসেবে সিদ্ধ ডিমের কুসুমের দ্রবণ দিনে ৪ বার দিতে হবে।
  • ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের ১০টি মাছের রেণুর জন্য একটি সিদ্ধ সু মের চার ভাগের এক ভাগ প্রতিবার সরবরাহ করতে হয়।
  • হাপাতে রেণু পোনাকে এভাবে ২৪-৩৬ ঘন্টা খাওয়াতে হবে। এ অবস্থায় রেণু পোনাকে নার্সারী পুকুরে মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

৫. নার্সারী পুকুরে পোনা লালন

৫.১ পুকুর নির্বাচন
নার্সারী পুকুরের আয়তন ২০-৪০ শতাংশ এবং গভীরতা ১.০-১.৫ মিটার হলে ভাল হয়।

৫.২ পুকুর প্রস্তুতি

  • পুকুর হতে অবাঞ্ছিত মাছ ও প্রাণী দূর করতে হবে।
  • পুকুর শুকিয়ে অবাঞ্ছিত প্রাণী দূর করা উত্তম, তবে পুকুর শুকানো স ম্ভব না হলে কয়েক বার জাল টেনে রাুসে মাছ ও অন্যান্য প্রাণী ধরে ফেলতে হবে।
  • নার্সারী পুকুরের চারপাশে ৩-৪ ফুট উঁচু মশারীর জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। ফলে ব্যাঙ ও সাপ পুকুরে প্রবেশ করে পোনার তিসাধন করতে পারবে না।
  • অবাঞ্ছিত প্রাণী দূর করার পর প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি হারে কলি চুন সম স্ত পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
  • চুন ও গোবর সার প্রয়োগের ৩ দিন পর রেণু পোনা মজুদের ব্যবস্থা নিতে হয়।
  • হাঁসপোকা ও ক্ষতিকারক প্লাংক্টন ধ্বংশ করার জন্য রেণু মজুদের ২৪ ঘন্টা আগে ৮-১০ মি.লি. সুমিথিয়ন প্রতি শতাংশে অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে।

৫.৩ রেণু পোনা মজুদ

  • নার্সারী পুকুরে ৪-৫ দিন বয়সের রেণু পোনা প্রতি শতাংশে ২৫,০০০-৩০,০০০ টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।
  • এ সময়ে নার্সারী পুকুরটিকে ১ মিটার উঁচু জাল দিয়ে ঘিরে দিলে ভাল হয়। এতে তিকর ব্যাঙ বা সাপ পুকুরে প্রবেশ করে পোনার তিসাধন করতে পারে না। প্রতি শতাংশে প্রথম ৩ দিন ২টি করে সিদ্ধ ডিমের কুসুম সকাল, দুপুর ও বিকালে ছিটিয়ে দিতে হবে।
  • ৪-৭ দিন সকালে ও দুপুরে ৩টি ডিম ও বিকালে ৫০ গ্রাম আটার দ্রবণ প্রতি শতাংশে রবরাহ কর তে হবে।
  • ৮-১২ দিন সকাল, দুপুর ও বিকেলে ১০০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হবে।
  • রেণু পোনা ছাড়ার ১৩-১৮ দিন সকাল, দুপুর ও বিকাল ২০০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হবে।
  • রেণু পোনা ছাড়ার ১৮ দিন পর চারা পোনায় পরিণত হয়, যা চাষের পুকুরে ব্যবহারের উপযোগী। নার্সারী পুকুরে প্রতি ১৫-২০ দিনে ২০-৩০% পানি পরিবর্তন করা উত্তম।

৬. থাই কৈ মাছের চাষ

৬.১ পুকুর নির্বাচন
মাছ চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ মাছ চাষের জন্য ৪-৬ মাস ন থাকে এ রকম ১৫-৫০ শতাংশের পুকুর নির্বাচন করতে হবে। তবে এর চেয়ে ছোট বা বড় পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায়।

৬.২ পুকুর প্রস্তুতি

  • পুকুরের পাড় মেরামত ও জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
  • পুকুর সেচে পানি শুকিয়ে অবাঞ্ছিত মাছ ও প্রাণী দূর করাতে হবে। পুকুর শুকানো সম্ভব হলে কয়েক বার জাল টেনে রাুসে মাছ ও অন্যান্য প্রাণী ধরে ফেলতে হবে।
  • প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ আবশ্যক।
  • চুন প্রয়োগের ৫ দিন পরে পোনা মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • পোনা মজুদের পূর্বে পুকুরের চারদিকে নাইলন নেটের ফেনসিং দিতে হবে।

৬.৩ পোনা সংগ্রহ
পুকুরেচাষের জন্য কৈ মাছের পোনা হ্যাচারী হতে সংগ্রহ করতে হবে। পোনা পলিথিন ব্যাগে অক্সিজেন দিয়ে পরিবহণ করতে হবে।

৬.৪ পোনা মজুদ
চারী থেকে সংগৃহিত ধানী পোনাকে কিছু দিন (১৫-২০) চারা ুরে রেখে দৈর্ঘ্য ৪-৬ সেন্টিমিটার বা ওজন ৩-৪ গ্রাম হলে স্ত্রী ছ আলাদা করে পালন পুকুরে মজুদ করলে ভাল ফল পাওয়া । পুকুর ব্যবস্থাপনা, খাদ্য প্রয়োগ ও খাদ্যের গুণগতমানের র নির্ভর করে প্রতি শতাংশে সুস্থ-সবল ৫০০-১০০০ টি ানা মজুদ করা যেতে পারে। পোনা মজুদের সময় পোনাকে মজুদকৃত পুকুরের পানির সাথে কন্ডিশনিং করে তারপর ছাড়তে হবে।
koi stocking density

৬.৫ কৈ মাছের পুষ্টি চাহিদা
ক মাছের আমিষ চাহিদা বিশেষ করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা কার্প বা রুই জাতীয় মাছের চাইতে বেশি। কৈ মাছের পানার আমিষের চাহিদা ৩০-৩৫% ও চাষযোগ্য মাছের ক্ষেত্রে তা ৩০%। পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য হতেও কৈ মাছের আমিষের কিছুটা চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। কৈ মাছের একটি আদর্শ খাবারে আমিষ ৩০-৩৫%, চর্বি ৪-৫%, শর্করা ৪%, অ্যাশ ১৪%, ফাইবার ৫% ও ময়েস্চার ১১% থাকা প্রয়োজন।
koi diet composition

koi feeding protocol

  • প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি পর্যবেণ করে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
  • পোনা মজুদের পর ৩০ দিন পর পর শতাংশ প্রতি ২৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে। কৈ মাছের পুকুরে প্রচুর প্লাংক্টনের আধিক্য পরিলতি হয়ে থাকে, এই প্লাংক্টন নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রতি শতাংশে মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা ১২টি ও সিলভার কার্পের পোনা ৪ টি মজুদ করা যেতে পারে।
  • মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মজুদ পুকুরে প্রতি ১৫-২০ দিনে ২০-৩০% পানি পরিবর্তন করা উত্তম।
  • প্রতি সপ্তাহে পানির গুণাগুণ যেমন পানির তাপমাত্রা, অক্সিজেন, পিএইচ, মোট ক্ষারকত্ব নণর্ য় করা আবশ্যক।

৬.৬ খাদ্য তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি

  • সূত্র অনুযায়ী উপাদানসমূহ নির্দিষ্ট পরিমাণে মেপে নিতে হবে এবং পরিষ্কার ও শুকনা স্থানে ঢেলে আস্তে আস্তে ভাল করে মেশাতে হবে।
  • ভালভাবে মেশানোর পর অল্প অল্প পানি এমনভাবে মেশাতে হবে যাতে মিশ্রণটি একটি আঠালো মন্ড বা পেস্টে পরিণত হয়।
  • পিলেট মেশিনের মাধ্যমে উক্ত আঠালো পেস্ট বা মন্ড থেকে পিলেট খাদ্য তৈরি করা যেতে পারে।
  • তৈরি পিলেট পলিথিন শিটে বা চাটাইয়ে বা শুকনা স্থানে রেখে ভালভাবে রোদে শুকাতে হবে।
  • পিলেটের আকার চাষকৃত মাছের মুখের আকার অনুযায়ী তৈরী করতে হবে। নির্দিষ্ট আকারের চালুনি ব্যবহার করে এটা করা যায়।
  • বাণিজ্যিক ভাবে প্রস্তুতকৃত ভাসমান পিলেট খাবার কৈ মাছের পুকুরে প্রয়োগ করা হচ্ছে সর্বোত্তম । এতে খাবারের অপচয় হয় না, অব্যবহৃত খাবার পচে পুকুরের পানি নষ্ট হয় না এবং কৈ চাষে উৎপাদন খরচ অনেক কমে যায়।

৬.৭ প্রস্তুতকৃত খাদ্য সংরণ পদ্ধতি

  • প্রস্তুতকৃত শুকনা পিলেট খাদ্য বায়ুরোধী পলিথিনের বা চটের অথবা কোন মুখবন্ধ পাত্রে ঠান্ডা ও শুষ্ক জায়গায় সংরণ করতে হবে। মাঝে মাঝে এই খাদ্য পুনরায় রোদে শুকিয়ে নিলে ভাল হয়।
  • স্টোরে বা গুদাম ঘরে সংরতি পিলেট খাদ্য মেঝেতে না রেখে কাঠের পাটাতনের উপরে রেখে সংরণ করা ভাল।
  • সংরতি পিলেট খাদ্য ২-৩ মাসের মধ্যে ব্যাবহার করে ফেলা উচিত।

৬.৮ খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি
koi feeding adult
৭. মাছ আহরণ
আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করলে ৩-৪ মাসের মধ্যে কৈ মাছের ওজন গড়ে ৯০-১০০ গ্রাম হবে। এ সময়ে জাল টেনে এবং পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে। আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে ৩-৪ মাসে একর প্রতি নিম্নের টেবিলে উল্লিখিত হারে কৈ মাছের উৎপাদন করা সম্ভব।
koi production
৮. পরামর্শ

  • কৈ মাছ চাষের জন্য সম্পূরক খাদ্যে প্রাণিজ আমিষ (ফিশ মিল, মিট ও বোন মিল, প্রোটিন কনসেন্ট্রেট, ব্লাড মিল ইত্যাদি) এবং ভিটামিন অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।
  • এধরনের মাছ চাষের জন্য ভাসমান পিলেট জাতীয় খাদ্যই সবচেয়ে ভাল।
  • পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার (বিশেষত জুওপ্লাংক্টন) উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী মাসে প্রতি শতাংশে ১০ কেজি হারে দুইবার গোবর প্রয়োগ করতে হবে।
  • ডুবন্ত খাবারের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে পুকুরে যে সমস্ত স্থানে খাদ্য প্রয়োগ করা হয় ঐ সমস্ত স্থান খাবার প্রয়োগের ১ ঘন্টা পর পর্যবেণ করে দেখা উচিত। যদি সেখানে খাবার পাওয়া যায় তা হলে বুঝতে হবে মাছ খাবার খাচ্ছে না অথবা খাবার বেশী দেওয়া হচ্ছে।
  • গ্রীষ্মকালে অনেক সময় পুকুরের পানি কমে যায় এবং তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তখন অনেক সময় পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। এরকম পরিস্থিতিতে খাবার প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে।
  • পোনা মাছের ক্ষেত্রে সপ্তাহে একবার এবং চাষযোগ্য মাছের ক্ষেত্রে ১৫ দিনে একবার নমুনা সংগ্রহ করে গড় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে মোট খাদ্যের পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে।

৯. কৈ মাছের সাধারণ রোগ ও তার প্রতিকার
উচ্চ মজুত ঘনত্ব ও বদ্ধ জলজ পরিবেশে পরিত্যক্ত খাবার, মাছের বিপাকীয় বর্জ্য ও অন্যান্য আবর্জনা পচনের ফলে পানি দূষিত হয়ে কৈ মাছের রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। কোন ট্যাঙ্ক, হ্যাচারী বা খামারে একবার জীবাণু প্রবেশ করলে তাকে সমূলে উচ্ছেদ করা অত্যন্ত কঠিন। তাই খামারে জীবাণু প্রবেশের সব ধরণের পথ বন্ধ করে দেয়াই আদর্শ মৎস্য চাষির কর্তব্য। রোগের ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ করা সবচেয়ে সুবিধাজনক পদ্ধতি। নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব –

  • নিরোগ ও সবল মাছের পোনা সংগ্রহ।
  • ট্যাঙ্ক/হ্যাচারী/খামার ও মাছ চাষের যাবতীয় সর ঞ্জাম জীবাণু মুক্তকরণ।
  • উচ্চ মজুদ হার পরিহার করা।
  • সকল প্রকার জীবাণু বাহক দূরে রাখার ব্যব্স্থা করা।
  • পরিমিত ও সুষম খাবার প্রয়োগ।
  • খামার ও মাছের পরিচর্যা নিশ্চিতকরণ।

সাধারণত পরিবহণের সময় পোনা যদি আঘাত পায় তবে ত রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও প্রজনন ও পালন পুকুরে কৈ মাছের ত রোগ হতে পারে। চাষী পর্যায়ে এই রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য যে সমস্ত স্থা গ্রহণ করা হয় তা নিম্নরূপ –

  • ক্ষত রোগের প্রাদুর্ভাব হলে জীবানুনাশক হিসাবে টিমসেন প্রতি শতাংশ পুকুরে (১ মিটার গভীরতা) ২.৬৫ গ্রাম হারে ব্যবহার করা যেতে পারে । একই সাথে এন্টিবায়োটিক হিসাবে ৩-৫ গ্রাম অক্সিটেট্রাসাইকিন প্রতি কেজি খাবারের সাথে মিশিয়ে ৩-৫ দিন ব্যবহার করতে হবে ।
  • জীবাণুনাশক হিসাবে কৈ মাছের পুকুরে অ্যাকুয়াম্যাজিক ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যবহার মাত্রা – প্রতি একর পুকুরে (১ মিটার গভীরতা) ৫ কেজি । এর সাথে ২৫০ গ্রাম চালের কুঁড়া ও ১০০ গ্রাম চিনি ১০ লিটার পানিতে ৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে প্রতি একর পুকুরে ছিটিয়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায় । পাশাপাশি এন্টিবায়োটিক হিসাবে ঙঝঝও-ঈ (ব্যবহার মাত্রা-৩-৫ গ্রাম প্রতি কেজি খাবারের সাথে মিশিয়ে ৩-৫ দিন) ব্যবহার করা যেতে পারে ।
  • পোনা মজুদের পর প্রতি শতাংশ ফুট পুকুরের জন্য ১০ গ্রাম কপার সালফেট ব্যবহারে ভাল ফল পাওয়া যায় । শীতকালে ত রোগে আক্রান্ত মাছের জন্য কপার সালফেট ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি প্রতি শতাংশ ফুট পুকুরে ০.৫- ১ কেজি খাওয়ার লবণ ব্যবহার করা যেতে পারে ।

তথ্যসূত্র:
ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেন, ড. মোঃ শাহাআলী, ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, ড. মোঃ আব্দুল ওহাব, ড. মোঃ সাইফুদ্দিন শাহ্ (২০১১) থাই কই মাছের পোনা উৎপাদনে হ্যাচারী ও চাষ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল; বাংলাদেশ ফিসারিজ রিসার্চ ফোরাম, ইনোভিশন কনসালটিং প্রাইভেট লিমিটেড ও ক্যাটালিষ্ট; ঢাকা, বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ২২।

বিস্তারিত তথ্যের জন্য তথ্যসূত্রের ডকুমেন্টটি নিচে যোগ করে দেয়া হল। ডকুমেন্টটির উৎস্য: http://www.bfrf.org

Answer for থাই কৈ মাছের পোনা উৎপাদনে হ্যাচারী ও চাষ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাই