দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের গুরুত্ব ও চাষের সম্ভাবনা  

আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ প্রানিজ আমিষের চাহিদা পূরণ ও জীবিকা নির্বাহে দেশীয় প্রজাতির মাছর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এদেশে রয়েছে অংসখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-দিঘী, হাওর-বাঁওড়, বিল ও প্লাবনভূমি যা মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ও চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আমাদের দেশে রয়েছে ১.০৩ মিলিয়ন হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নদী ও মোহনা, ১১৪ হাজার হেক্টর বিল, ৬৮ হাজার হেক্টর আয়তনের কাপ্তাই লেক, ৫ হাজার হেক্টর জলায়তনের বাঁওড় বা মরা নদী, প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর আয়তনের সুন্দরবনের খাড়ি অঞ্চল এবং ২৮.৩ লক্ষ হেক্টর আয়তনের প্লাবনভূমি। অতীতে এই বিশাল জলাভূমি প্রাকৃতিক ভাবেই মৎস্য সম্পদে ভরপুর ছিল । ষাট ও সত্তর দশকে এদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ আসতো এসব জলাভূমি থেকে। আহরিত মাছের যেমন ছিল প্রাচুর্যতা তেমনই ছিল তার প্রজাতি বৈচিত্র্য। দেশে মিঠা পানির মাছের প্রজাতির সংখ্যা ২৬০ এবং চিংড়ির প্রজাতির সংখ্যা ২৪। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলেরই দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার অন্যতম উপাদান ছিল দেশীয় ছোট প্রজাতির বৈচিত্র্যপূর্ণ এসব মাছ। সে সময় আমিষের উৎস হিসেবে দুধ, ডিম বা মাংস এত সহজলভ্য ছিল না, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আমিষের প্রধান উপাদানই ছিল এ ছোট প্রজাতির দেশীয় মাছ।

দেশীয় ছোট প্রজাতির মাছের প্রাচুর্যতা ও উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টিহীনতার জন্য দেশীয় ছোট মাছের অপ্রাপ্যতা অনেকাংশেই দায়ী। পাশাপাশি গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সর্বত্রই এসব মাছের ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। অন্যদিকে ছোট মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় দরিদ্র মৎস্যজীবীদের আয়ের উৎসও আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। এসব ছোট মাছের মধ্যে ৫০টি প্রজাতি সচরাচর অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে পাওয়া যায়; যার উল্লেখযোগ্য অংশ ক্রমেই সংকটাপন্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ এ সকল দেশীয় প্রজাতির মাছের পুষ্টিগুণ ও বাজার মূল্য অনেক বেশি। দেশের মোট উৎপাদনের মধ্যে (২৩.২৯ লক্ষ মেট্রিক টন) প্রায় ১১ শতাংশ আসে বিদেশী প্রজাতির মাছ থেকে। স্থানীয় রুই জাতীয় মাছ থেকে আসে প্রায় ২২ শতাংশ এবং শতাংশের বেশি আসে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ থেকে। পসিংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় উৎপাদিত মাছের সিংহভাগই (প্রায় ৯০ শতাংশ) দেশীয় প্রজাতির মিঠাপানির মাছ। তাই মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় দেশীয় প্রজাতির মাছ সকল বিবেচনায় অগ্রাধিকারযোগ্য।

বিগত দু’দশক ধরে বাজারে ছোট মাছের অভাব দেখা যাচ্ছে। প্রাকৃতিক জলাশয়েও আগের মতো দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ আর দেখা যায় না। প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন, অধিক আহরণ, অপরিকল্পিত বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ, জলাশয় ভরাট, মাছের ক্ষত রোগ, কৃষি জমিতে সার ও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে এদেশের জনপ্রিয় ছোট মাছগুলো মারাত্মক হুমকির মুখে। বিগত দশকে ভাবা হতো ছোট মাছ বড় মাছের মতো বাড়ন্ত নয় ও তাদের প্রতিযোগী; ছোট মাছের বাজার দরও ছিল কম। এসব কারণে মাছ চাষিরা রুইজাতীয় মাছের সাথে দেশীয় ছোট মাছ পুকুরে চাষ করতে হবে একথা চিন্তাই করত না। বরং পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে এদের সমূলে বিনাশ করে ফেলতো। দরিদ্র মাছ চাষিরা তাদের পুকুরে রুইজাতীয় মাছের চাষ ঠিকই করছে, কিন্তুু তারা পরিবারের পুষ্টির প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে মাছ বিক্রি করে অর্থ উপার্জনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তাতে করে মাছ চাষ করেও তাদের পরিবারের সদস্যদের পুষ্টিহীনতা থেকেই যাচ্ছে। এ বাস্তবতার নিরিখে দরিদ্র মানুষের নগদ অর্থ ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে রুইজাতীয় মাছের সংগে ছোট মাছের মিশ্রচাষের বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এভাবে চাষের মাধ্যমে কিছু মাছকেও যদি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় তাহলে তা মাছের জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও সহায়ক হবে।

তথ্যসূত্র: DoF, Bangladesh

Answer for দেশীয় ছোট মাছের গুরুত্ব ও চাষের সম্ভাবনা বিষয়ে জানতে চাই