রুইজাতীয় মাছের সাথে বাটা মাছের মিশ্রচাষ
বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে বাটা অন্যতম। রূপালি আঁশের এ মাছের দেহ লম্বা ও সরু, পিঠের দিকটা সামান্য কালচে রংয়ের হয়। বাটা জলাশয়ের নিচের স্তরে বাস করে এবং তলদেশের পচা উদ্ভিদ, প্রাণিকণা, শেওলা, বেনথোস ইত্যাদি খায়। বাটা মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি, তবে এরা বদ্ধ জলাশয়ে ডিম দেয় না। বর্তমানে কার্প হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে বাটার পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে।
চাষের সুবিধা/গুরুত্ব
- বাটা অন্যান্য রুইজাতীয় মাছের সাথে একত্রে চাষ করা যায়।
- ছোট-বড় সব ধরণের জলাশয়েই বাটা মাছ চাষ করা যায়।
- বাজার মূল্য অনেক বেশি এবং রুইজাতীয় অন্যান্য মাছের তুলনায় বাটা ছোট অবস্থায় যে কোন সময় বাজারজাত করা যায়।
- প্রনোদিত প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত পোনা সারা বছর পাওয়া যায়।
- এ মাছের পেশী চর্বিযুক্ত ও সুস্বাদু।
- বছরে দু’টি ফসল উৎপাদন করা যায়।
চাষ পদ্ধতি
পুকুর প্রস্ত্ততি
- শুকনো মৌসুমে পুকুর থেকে জলজ আগাছা পরিষ্কার ও পাড় মেরামত করতে হবে।
- ছোট মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর শুকানো উচিত নয়। তাই বার বার ঘন ফাঁসের জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ ও ক্ষতিকর প্রাণী অপসারণ করতে হবে।
- প্রতি শতকে ১-২ কেজি পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। মাটির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে চুনের মাত্রা
কম-বেশি হতে পারে। - পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমান প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মানোর জন্য পোনা ছাড়ার পূর্বে সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতকে ৪-৬ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসটি প্রয়োগ করা ভাল।
- পানির রং সবুজ/বাদামী সবুজ হলে পুকুর পোনা ছাড়ার উপযুক্ত হয়।
পোনা মজুদ
পুকুরে মাছ চাষের সফলতা নির্ভর করে ভালো জাতের সুস্থ, সবল ও সঠিক প্রজাতির পোনা সঠিক সংখ্যায় মজুদের ওপর। পুকুরে পোনা ছাড়ার আগে ১০ লিটার পানি ও ১ চামচ (৫ গ্রাম) পটাসিয়াম পারম্যাংগানেট দ্রবণ অথবা ১০০ গ্রাম লবণ দ্রবণে গোছল করিয়ে পোনা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মিশ্র চাষের পুকুরে প্রতি শতকে পোনা মজুদের হার নিম্নরূপঃ-
প্রজাতি | সংখ্যা | আকার (সেমি) |
সিলভার কার্প | ১২ | ১০-১৫ |
রুই | ৬ | ১০-১৫ |
গ্রাসকার্প | ২ | ১০-১৫ |
বাটা | ৫০ | ৫-৭ |
মোট | ৭০ |
মজুদ পরবর্তী পরিচর্যা
- পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমান প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য দৈনিক বা ৭ দিন পর পর নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হয়।
- সাধারণ নিয়ম অনুসারে দৈনিক প্রতি শতকে ১৫০ গ্রাম গোবর অথবা ৩০০ গ্রাম কম্পোস্ট, ৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫ গ্রাম টিএসপি একটি পাত্রে পানির সাথে ১ দিন ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকাল ১০/১১টায় সারা পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে।
- জৈব ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে পরিমাণমত ও নিয়মিত ব্যবহার করলে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়।
সম্পুরক খাদ্য সরবরাহ
- কার্প-বাটা মিশ্র চাষে সম্পুরক খাবার হিসাবে ১ঃ ২ অনুপাতে সরিষার খৈল ও গমের ভুসি বা চালের মিহি কুঁড়া ব্যবহার করা যায়।
- ১০-১২ ঘন্টা ভিজানো সরিষার খৈলের সাথে শুকনো গমের ভুসি বা চালের মিহি কুঁড়া মিশিয়ে গোলাকার বল তৈরি করতে হবে।
- পুকুরে পোনা মজুদের প্রথম দু’মাস মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের শতকার ৫ ভাগ হিসাবে দৈনিক খাবার দিতে হবে।
- দু’মাস পর হতে মাছের ওজনের শতকরা ৩ ভাগ হিসাবে খাবার দিলেই চলবে।
- শীতকালে খাবারের পরিমাণ শতকরা ১-২ ভাগ হিসাবে সরবরাহ করতে হবে।
- হিসাবকৃত মোট খাবার দিনে ২ বার প্রয়োগ করা ভাল।
- মাছের মাসিক নমুনায়নের মাধ্যমে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
সতর্কতা:
- পুকুরের তলদেশে কাদা থাকলে ক্ষতিকর গ্যাস জমে থাকতে পারে। দড়ির সাথে লোহা বা মাটির কাঠি কিংবা ইট বেঁধে হররা তৈরি করে পুকুরের তল ঘেষে আস্তে আস্তে টেনে তলার গ্যাস বের করে দিতে হবে।
- প্রতি মাসে একবার কিছু মাছ ধরে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
আহরণ:
চাষির প্রয়োজনমাফিক মাছের আকার, বাজার দর ও চাহিদা অনুযায়ী পুকুর হতে মাছ আহরণ করা প্রয়োজন। আহরণের পূর্বে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি (জাল, পরিমাপক যন্ত্র, ঝুঁড়ি, বরফ ইত্যাদি) ও পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আহরণ দু’ভাবে করা যায়-
আংশিক আহরণ:
পুকুরে মজুদকৃত পোনা ৫-৬ মাস প্রতিপালনের পর বাজারজাতকরণের উপযুক্ত বড় মাছগুলো ধরে ফেলতে হবে। যে কয়টি মাছ বিক্রি বা ধরা হবে, একই জাতের সমসংখ্যক বড় আকারের পোনা আবার পুকুরে ছাড়তে হবে। এতে একই পুকুর থেকে বেশি পরিমাণে উৎপাদন পাওয়া যায়।
চুড়ান্ত আহরণ:
বাজার দর এবং পরবর্তী ফসলের জন্য পোনা প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে চুড়ান্ত আহরণের সময়কাল ঠিক করতে হবে। মাছ আহরণের পর পুকুর প্রস্ত্তত করে পুনরায় মাছ চাষের উদ্যোগ নিতে হবে।
আয়-ব্যয়ের হিসাব:
একটি ৩০ শতক আয়তনের পুকুরে ৬ মাসে কার্প-বাটা মিশ্র চাষের আয়-ব্যয় ও উৎপাদনের হিসাব নিচে দেখানো হলো।
ব্যয়:
ব্যয়ের বিবরণ | সংখ্যা/পরিমান | মূল্য (টাকা) |
পুকুর মেরামত/সংস্কার | – | ১০০০.০০ |
চুন | ৩০ কেজি | ৪৫০.০০ |
ইউরিয়া | ৩০ কেজি | ১৮০.০০ |
টিএসপি | ৩০ কেজি | ৬০০.০০ |
গোবর | ৭৫০ কেজি | ৭৫০.০০ |
পোনা | ১৮০০ টি | ১,৮০০.০০ |
চালের মিহি কুড়া | ১০০০ কেজি | ১০,০০০.০০ |
সরিষার খৈল | ৬০০ কেজি | ১২,০০০.০০ |
মাছ ধরা ও অন্যান্য | – | ৩০০০.০০ |
মোট ব্যয় | ২৯৭৮০.০০ |
উৎপাদন ও মুনাফা:
রুইজাতীয় ও বাটা মাছ উৎপাদন = ৭৫০ কেজি
গড় মূল্য প্রতি কেজি ৬০.০০ টাকা হিসেবে আয় = ৪৫,০০০.০০ টাকা
মুনাফা = (আয় – ব্যয়) = (৪৫,০০০.০০-২৯,৭৮০.০০) = ১৫,২২০.০০ টাকা।
———————————-
তথ্যসূত্র: DoF, Bangladesh