যেসব দ্রব্য গ্রহণের ফলে মাছের দেহের বৃদ্ধিসাধন, ক্ষয়পূরণ ও শক্তি উৎপাদন হয় এবং মাছ বংশবৃদ্ধি করার উপযোগি হয় সেগুলোকে মাছের খাদ্য বলা হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য পুকুরে পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা অপরিহার্য। খাদ্যদ্রব্য বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক (natural) ও সংশ্লেষী (synthetic) রাসায়নিক উপকরণের সমন্বয়ে গঠিত। জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন ও পানির ন্যায় খাদ্যও অতি প্রয়োজনীয়। অক্সিজেন ও পানি খাদ্যের অন্যতম উপকরণ। পরিমিত পরিমাণে খাদ্যের যোগান দিয়ে মাছের অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। মাছের বংশ বৃদ্ধিতে খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুষম খাদ্য গ্রহণে মাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং মাছ যথাসময়ে যৌন পরিপক্বতা লাভ করে। এতে মাছের জনন গ্রন্থি (gonad) পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় এবং ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মাছের জীবনযাত্রার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, যথা- রক্ত সংবহন, শ্বাসকার্য পরিচালনা, অভিস্রবণীয় চাপ নিয়ন্ত্রণ, প্রলম্বন (suspension) ও পানির ভিতরে স্থিতাবস্থানের জন্য প্রচুর পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন হয়। মাছ গৃহীত খাদ্য থেকে এ শক্তি পায়। এ কারণে শৈশব অবস্থা থেকেই মাছকে নিয়মিত ও সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। মাছের পুকুরে খাদ্য সরবরাহ হঠাৎ ব্যাহত হলে এবং দীর্ঘ সময় খাদ্য প্রদান বন্ধ থাকলে মাছ বন্ধ্যাত্বের শিকার হতে পারে। সুস্থ সবল পোনা উৎপাদনের জন্য পরিপক্ব মাছকে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাদ্য প্রদান করা দরকার।
প্রাকৃতিক খাদ্য
মাছের জীবনধারণের মাধ্যম পানি। কোন জলাশয়ের পানিতে স্বাভাবিকভাবে যে সব খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হয়, সেগুলোকে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য বলা হয়। প্ল্যাঙ্কটন, জলজ কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদ, ক্ষুদে পানা, পুকুরের তলদেশের পচা জৈব পদার্থ, ইত্যাদি মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য।
সম্পূরক খাদ্য
অধিক উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য যোগানের পাশাপাশি পুকুরের বাইরে থেকে কিছু খাদ্য দেয়া হয়। বাইরে থেকে দেয়া এসব খাদ্যদ্রব্যকে সম্পূরক খাদ্য বলা হয়। চাউলের কুঁড়া, গমের ভুসি, সরিষার খৈল, ইত্যাদি মাছের সম্পূরক খাদ্য।
গুরুত্ব:
মাছ চাষের জন্য জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমিত যোগানদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের খাদ্য চক্রকে সচল রাখে। ফলে জলাশয়ে মাছের বিভিন্ন প্রকার খাদ্য উপাদান চক্রাকারে ও অবিরতভাবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। এতে মাছের দেহের স্বাভাবিক পুষ্টি সাধন ও বৃদ্ধি ঘটে থাকে এবং জলাশয়ের জৈব ভারসাম্য (biological equilibrium) বজায় থাকে। ব্যাপক ভিত্তিক (extensive) মাছ চাষের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খাদ্যই মাছের পুষ্টির একমাত্র উৎস।
প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের স্বাভাবিক খাবার। এজন্য মাছ সহজেই প্রাকৃতিক খাদ্য গ্রহণ করে। প্রাকৃতিক খাদ্যের পুষ্টিমান বেশি এবং এগুলো সহজেই হজম হয়। এ কারণে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিবর্তন হার (conversion rate) সূচক সংখ্যামান কম, যা অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করে।
গোবর, হাস-মুরগির বিষ্ঠা ইত্যাদি জৈব সার সহজলভ্য এবং দামে অপেক্ষাকৃত সস্তা। এসব জৈব সার ব্যবহার করে পানিতে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাংঙ্কটন জলাশয়ের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
শেপারক্লাউস (Schaperclaus) মনে করেন যে কার্পজাতীয় মাছ চাষের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাদ্যের ৫০ শতাংশ প্রাকৃতিক খাদ্য হওয়া উচিত। তাল এবং হেপার (Tal and Hapher) তাঁদের পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখেছেন যে, পুকুরে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্য কার্প জাতীয় মাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। তেলাপিয়ার জন্য পুকুরে ন্যূনতম ১০ শতাংশ প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগান থাকা দরকার।
পুকুরের বিভিন্ন স্তর হতে খাদ্য গ্রহণকারী বিভিন্ন প্রজাতির মাছকে যথাযথ পরিমাণে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা যায় না। তাছাড়া, সব প্রজাতির মাছ সম্পূরক খাদ্য গ্রহণের সমান উৎসাহ দেখায় না। আবার একই জলাশয়ে একই সময়ে বিভিন্ন ধরণের সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য।
কৃত্রিম বা সম্পূরক খাদ্য প্রাকৃতিক খাদ্যের বিকল্প নয়, পরিপূরক মাত্র। অনেক সময় সম্পূরক খাদ্য সুষম হয় না। এ জন্য মাছ চাষে প্রকৃতিক খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
- মাটি ও পানির স্বাভাবিক উর্বরতায় কোন জলাশয়ে যেসব খাদ্যদ্রব্য উৎপাদিত হয় সেগুলোকে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য বলে;
- প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রধান উৎস;
- উদ্ভিদ প্রাণী নির্বিশেষে পানিতে স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান প্রায় সব জীবই মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য। বেনথোস, ম্যাক্রোফাইট ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়;
- মাছ চাষের জন্য জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমিত যোগানদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ;
- কৃত্রিম বা সম্পূরক খাদ্য প্রাকৃতিক খাদ্যের বিকল্প নয়, পরিপূরক মাত্র;
- উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খাদ্যই মাছের পুষ্টির একমাত্র উৎস
তথ্য সূত্র: DoF