রুই জাতীয় মাছের সাথে মলা ও পুঁটির মিশ্রচাষ করা সম্ভব। বিস্তারিত নিচে দেয়া হল –
পুকুর নির্বাচন
- দোআঁশ ও এঁটেল-দোআঁশ মাটির পুকুর মিশ্রচাষের জন্য ভাল।
- মিশ্রচাষের জন্য পুকুরের আয়তন ২০ শতকের বড় এবং পানির গড় গভীরতা ৫-৭ ফুট থাকা উত্তম।
- পুকুর আয়াতাকার হলে ব্যবস্থাপনা সহজ হয়।
- পুকুর বন্যা মুক্ত এলাকায় হতে হবে।
পুকুর প্রস্ত্ততি
- পুকুর পাড়ের ঝোপঝাড় ও বড় গাছপালা ছেটে দিতে হবে যাতে পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্য্যের আলো পড়তে পারে।
- পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা (১ ফুটের বেশি) থাকলে তা উঠিয়ে ফেলতে হবে।
- বার বার ঘন ফাঁসের জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ দমন করতে হবে।
- প্রতি শতকে ১.০-১.৫ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রতি শতকে ৫-৭ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
পোনা মজুদ
- পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মেছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে পোনা ছাড়তে হবে।
- বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহে মলা ও পুঁটি সংগ্রহ করে মজুদ করতে হবে। যাতে এরা মজুদ পুকুরে ডিম ছেড়ে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে।
- সারা বছর পানি থাকে এমন পুকুরে মলা ও পুঁটি একবার মজুদ করলেই চলে। এরা পুকুরের কিনার ঘেঁষে ভাসমান লতা-পাতায় ডিম ছাড়ে। তাই প্রজননের ২০-২৫ দিন পর পোনাগুলো ঝাঁক বেঁধে ভাসতে দেখা যায়, এ সময় জাল টানা উচিত নয়। এতে পোনা মাছের ক্ষতির আশংকা থাকে।
- শতক প্রতি পোনার মজুদ ঘনত্ব নিম্নরূপ-
| মাছের প্রজাতি | মডেল-১ | মডেল-২ | ||
| পোনার সংখ্যা | পোনার আকার (ইঞ্চি) | পোনার সংখ্যা | পোনার আকার (ইঞ্চি) | |
| রুই | ১৩ | ৪-৫ | ১৩ | ৪-৫ |
| কাতলা | ১৩ | ৪-৫ | ৬ | ৪-৫ |
| মৃগেল/কার্পিও | ১৪ | ৪-৫ | ১৩ | ৪-৫ |
| সিলভার কার্প | – | – | ৬ | ৪-৫ |
| গ্রাস কার্প | – | – | ২ | ৪-৫ |
| মলা | ১০০ | – | ১০০ | – |
| পুঁটি | ১০০ | – | ১০০ | – |
| সর্বমোট | ২৪০ | – | ২৪০ | – |
পোনা অভ্যস্তকরণ ও মজুদ
- পোনা পরিবহনের ব্যাগ/হাড়ি প্রথমেই ২০-৩০ মিনিট পানিতে ভাসিয়ে রেখে তাপমাত্রার সমতা আনতে হবে।
- তাপমাত্রা সমান না হওয়া পর্যন্ত পাত্রের কিছু পানি পুকুরে এবং পুকুরের কিছু পানি পাত্রে দিতে হবে।
- উভয় পানির তাপমাত্রা সমান হলে পাত্রের মুখ পানিতে কাত করে ডুবিয়ে পানির স্রোত দিলে পোনা দল বেঁধে স্রোতের বিপরীত দিকে বেরিয়ে যাবে।
অতিরিক্ত পোনা মজুদের কুফল
- মাছের খাদ্য, অক্সিজেন ও আবাসস্থলের ঘাটতি হয়।
- মাছের বৃদ্ধি আশানুরূপ হয় না।
- মাছ বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হয়।
- মাছকে সকালে খাবি খেতে দেখা যায় এবং অনেক সময় মাছ মারা যায়।
- অপুষ্টির কারণে মাছের মাথা মোটা ও শরীর চিকন হতে দেখা যায়।
- সার ও খাবার ব্যবহার করার পরও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না।
মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
খাদ্য প্রয়োগ
- প্রতিদিন পুকুরে মাছকে বাইরে থেকে খাবার দেয়া প্রয়োজন।
- মাছ ছাড়ার পরের দিন হতে রুইজাতীয় মাছের ওজনের ৩-৪% হিসাবে চালের কুঁড়া/গমের ভূষি ও সরিষার খৈল ২ঃ১ অনুপাতে মিশিয়ে পুকুরে দিতে হবে। মলা ও পুঁটির জন্য বাড়তি খাবার দেয়ার প্রয়োজন নেই।
- গ্রাস কার্পের জন্য কলাপাতা বা নরম ঘাস দিতে হবে।
সার প্রয়োগ
- পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য (প্লাঙ্কটন) জন্মানোর জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা আবশ্যক।
- পোনা মজুদের পর হতে পানির রং পর্যবেক্ষণ করে ৭-১০ দিন পর পর প্রতি শতকে ৪-৫ কেজি গোবর সার, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে সারের পরিমাণ কম-বেশি করা যাবে।
মাছ আহরণ ও বিক্রয়
- মলা ও পুঁটি মাছ বছরে ২-৩ বার ডিম দেয়। তাই ডিম ছাড়ার ১০-১৫ দিন অন্তর মলা মাছের আংশিক আহরণ জরুরী। আংশিক আহরণ না করলে মাছের ঘনত্ব বেড়ে যায় ও খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে।
- পোনা মজুদের ৬-৭ মাস পর রুইজাতীয় মাছের উৎপাদন বা বাজার দর দেখে আংশিক আহরণ করে বাজারজাত করা যেতে পারে।
- আংশিক আহরণ করা পুকুরে শতকরা ২০ ভাগের অধিক হারে বড় আকারের পোনা মজুদ করতে হবে।
- কার্পের সাথে মলা ও পুঁটির চাষ করে চাষি দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়েও বাড়তি আয়ের সংস্থান করতে পারে।
- এ পদ্ধতিতে ৬-৭ মাসে প্রতি শতকে ১৫-২০ কেজি মাছের উৎপাদন পাওয়া যেতে পারে।
রোগ-বালাই ও তার প্রতিকার
অন্যান্য জীবের ন্যায় ছোট মাছও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। পুকুরের মাছ সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পরজীবি ইত্যাদি জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। এছাড়া অপুষ্টি ও খাদ্যের অভাব, অক্সিজেনের অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে মাছের রোগ হয়। মাছের ক্ষেত্রে রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম পন্থা। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে পুকুর প্রস্ত্ততি সঠিকবাবে করতে হবে। অন্য পুকুরে ব্যবহৃত জাল শোধন ব্যতীত পুকুরে ব্যবহার করা উচিত নয়। তাছাড়া শীতের শুরুতে (ভাদ্র-আশ্বিণ) পুকুরের প্রতি শতক জলায়তনে ২৫০ গ্রাম চুন ও ২৫০ গ্রাম লবণ প্রতি সপ্তাহে একবার করে ৪-৬ সপ্তাহ প্রয়োগ করলে মাছ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
আয়-ব্যয়
মিশ্রচাষে এক একর পুকুরে ৮-৯ মাসে রুই জাতীয় মাছের সাথে মলা ও পুঁটি চাষে আয়-ব্যয়ের হিসাব –
| খাত | মিশ্রচাষ | |
| পরিমাণ | মূল্য (টাকা) | |
| ব্যয় | ||
| ইজারা মূল্য | ২০০০০ | |
| পুকুর সংস্কার মজুরী | ২০০০ | |
| চুন | ১০০ কেজি | ১৫০০ |
| গোবর | ৮০০ কেজি | ৪০০ |
| মাছের পোনা | ২৪০০০ টি | ১৮০০০ |
| খাদ্যচালের কুড়া
সরিষার খৈল |
৪৫০০ কেজি
১১০০ কেজি |
৫৪০০০
২২০০০ |
| সারইউরিয়া
টিএসপি গোবর |
১৬০ কেজি
৮০ কেজি ৬৪০০ কেজি |
১২৮০
৩৬০০ ৩২০০ |
| বিবিধ | ২০০০ | |
| সর্বমোট ব্যয় | ১২৭৯৮০ | |
| আয়মাছ বিক্রয়:
রুইজাতীয় মাছ- ১৬০০ কেজি (@ ৮০ টাকা) মলা ও পুঁটি- ৮০০ কেজি (@ ১০০ টাকা) |
২০৮০০০ | |
| প্রকৃত মুনাফা | ৮০০২০ | |
———————————-
তথ্যসূত্র: DoF, Bangladesh
