আমিষ আমাদের খাদ্যের ছয়টি উপাদনের একটি। এটি হলো সব জীবের মুখ্য উপাদান। ২০টি বিভিন্ন রকম এমিনো এসিডের নানা রকম সমন্বয়ে গঠিত হয় এক একটি আমিষ। অধিকাংশ আমিষে ১০০ থেকে ১০০০টি এমিনো এসিড থাকে। এর অর্থ হলো ২০টি এমিনো এসিডের বহু রকম সংযোগ তৈরির সুযোগ আমিষে থাকে। আমাদের খাদ্যে আমিষ এবং গুণমান সম্পন্ন আমিষের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আমিষ ঘাটতির কারণ একাধিক। আমিষ প্রধান খাদ্যের দাম অধিক হওয়ায় ব্যাপক জনগোষ্ঠী নিয়মিত মাছ, মাংস, ডিম, দুধ বা ডাল জাতীয় দানা শস্য তাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। ফলে খাদ্যে আমিষ ঘাটতি হওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। ভাত, আটা এসব শর্করা প্রধান খাদ্য থেকে আমাদের শতকরা ৬০ ভাগেরও অধিক আমিষ গ্রহণ করতে হয়। এদের প্রতিটির আমিষে এক বা একাধিক এমিনো এসিডের ঘাটতি থাকায় এরা শতভাগ পরিপূর্ণ গুণমান সম্পন্ন আমিষ নয়। ফলে একদিকে আমাদের খাদ্যে যেমন আমিষের ঘাটতি রয়েছে অন্যদিকে আমাদের খাদ্যের মাধ্যমে গৃহীত আমিষে অত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের ঘাটতি থাকায় সুষম আমিষ গ্রহণ থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
আমাদের দেহে আমিষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাগুলো হলো

  • আমিষ এনজাইমে রূপান্তরিত হয় আর এনজাইম কোষে সংঘটিত সব বিক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে
  • আমিষ কোষের গাঠনিক উপাদান
  • আমিষ DNA ও RNA তৈরির জন্য এমিনো এসিড সরবরাহ করে
  • কোষের নানা রকম কার্যাবলির নিয়ন্ত্রক
  • দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আবশ্যিক উপাদান
  • রক্ত ধারায় প্রবাহিত অক্সিজেনের বাহক
  • কখনও কখনও শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে
  • আমিষ দেহের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয়।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিষজাতীয় খাদ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাংলাদেশের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক আমিষের অনুমোদিত মাত্রা হলো ৩৩-৬৬ গ্রাম। সহজ হিসেবে প্রতি ১ কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন একজন সুস্থ সবল পরিণত মানুষের জন্য ০.৮-১.০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করা উচিত। গর্ভবতী মহিলা আর দুগ্ধদানকারী মায়েদের কিছুটা বাড়তি আমিষ চাহিদা পূরণ করতে হয়। গর্ভবতী মহিলার জন্য এবং ৭-১২ মাস বয়সী শিশুর মায়ের জন্য স্বাভাবিক আমিষের সঙ্গে বাড়তি দৈনিক ১৩-১৪ গ্রাম আমিষ যোগ করতে হয়। তবে শিশুর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মূলত মায়ের দুধের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় বলে মায়ের জন্য বাড়তি দৈনিক ১৯ গ্রাম আমিষ যোগ করতে হয়।

দেহের ওজন ভেদে আমিষের চাহিদা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সহজ হিসেবে প্রতিদিন প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮৩ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করা উচিত। এফএও কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা মতে এদেশের শতকরা ৬৬ ভাগেরও অধিক মানুষ প্রতিদিন ৫০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করে। তবে এখানে শতকরা ১০ ভাগ মনুষ ৪০ গ্রামের কম আমিষ গ্রহণ করে। গড়ে এদেশের মানুষের আমিষ গ্রহণের মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার বেশ কাছাকাছি। তবে সমস্যা এ যে, আমাদের দেশে শতকরা ৭৫ ভাগ আমিষ মানুষ গ্রহণ করে ফসলজাত খাদ্য থেকে। দানা শস্যজাত আমিষের তত উন্নত নয় বলে মানুষের অত্যাবশ্যকীয় এমিনো এসিডের ঘাটতি ঘটা খুবই স্বাভাবিক। তবে ডাল গ্রহণের মাত্রা কিছুটা বাড়লে ঘাটতি বেশ কিছুটা হ্রাস পায়। এখন এদেশে ডাল গ্রহণের দৈনিক মাত্রা মাত্র ১৪ গ্রাম যা কেবল চাল থেকে গৃহীত শতকরা ২৫ ভাগ আমিষের গুণমান বৃদ্ধি করে থাকে।
ইদানীংকালে পরিচালিত গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, গর্ভবতী মহিলা যদি প্রয়োজনীয় পরিমাণ আমিষ গ্রহণ না করতে পারে তবে সন্তানের ধীমান বেশ ধীরে বিকশিত হয়। শিশু জন্ম নেয়ার পর যতদিন দুগ্ধ পান করে ততদিন মায়ের খাদ্যের আমিষ সরবরাহ করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হয় শিশুটির স্বার্থেই। সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় কেবল বাড়তি আমিষ নয় বরং গর্ভবতী মহিলাকে বাড়তি ক্যালরি, অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন আর খনিজ দ্রব্যও সরবরাহ করতে হয়।

খাদ্যে আমিষের ঘাটতিজনিত কারণে শিশুদের এক রকম রোগ হয়। একে গা ফোলা রোগ বা কোয়াশিওরকর রোগ বলা হয়। বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ হওয়ার পর একাধারে স্টার্চ প্রধান খাবার খাওয়ানোর ফলশ্রুতিতে এ রোগ দেখা দেয়। গোড়ার দিকে এ ধরনের রোগীর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও ওজন হ্রাস পায়। হাত-পায়ের গিঁট বা সম্পূর্ণ দেহ ফুলে যেতে পারে। চেহারায় পা-ুরতা ফুটে ওঠে এবং হিমোগ্লোবিন উৎপাদন হ্রাস পায়। এ ধরনের রোগীর পাতলা পায়খানা হতে পারে এবং বদহজম দেখা দিতে পারে। মলের সঙ্গে আধা হজম খাদ্যও বের হয়ে আসতে পারে। এসব রোগীর অন্যান্য লক্ষণও দেখা দিতে পারে। ক্ষুধামন্দা, চুল বিবর্ণ হওয়া, চুল আলগা হয়ে যাওয়া, ত্বকে বাদামি কালো বর্ণের দাগ ইত্যাদি লক্ষণও প্রকাশ পেতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে পায়ের পাতা ফোলা এবং বমি অন্যতম প্রধান লক্ষণ। আমিষের অভাবে শিশুদের মস্তিষ্ক  ঠিকমতো বিকাশ লাভ করতে পারে না। অবস্থা খারাপ হলে শিরার ভেতর দিয়ে স্যালাইন দিয়ে এর নিরাময়ের কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়। অবশ্য মুখ দিয়ে স্যালাইন খাবার উপযোগী হলে তা মুখে খাওয়ানোই উত্তম। আমিষের ঘাটতির কারণে এ রোগ দেখা দেয় বলে সহজে হজম করতে পারে তেমন তরল খাবার প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রথমে পানি মেশানো দুধ এবং আস্তে আস্তে পানির পরিমাণ কমাতে কমাতে স্বাভাবিক দুধ পান করতে দিতে হবে। রোগীর হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে কঠিন খাবার যেমন- ডিম, নরম মাংস, দানা জাত খাদ্য, সবজি, ফল বা ফলের রস খাওয়ানো যেতে পারে। ডাল-ভাত মিশিয়ে খেলে আমিষের ঘাটতি সহজেই পূরণ হতে পারে। বেশ কিছুদিন এভাবে খাওয়ালে আর যত্ন নিলে ধীরে ধীরে এ রোগের উপশম হয়ে থাকে।
 

 
তথ্যসূত্র:

  • ভূঁইয়া মো. শহীদুর রশীদ (২০১৫) দেহের জন্য আমিষের গুরুত্ব। কৃষিকথা, বর্ষ ১৪২১ সংখ্যা কার্ত্তিক। কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)
Answer for আমিষ কী? এটি কী কাজে আসে?