ধানক্ষেতে যুগপৎ পদ্ধতিতে ছোট মাছ চাষ ব্যবস্থাপনা নিচে দেয়া হল-
জমি নির্বাচন
জমি নির্বাচনের ওপর ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সফলতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই জমি নির্বাচনে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ বিবেচনা করা উচিত।
- জমিটি অপেক্ষাকৃত সমতল হওয়া উচিত যাতে জমিতে পানির গভীরতা সব জায়গায় সমান থাকে।
- জমিটি যেন বন্যায় প্লাবিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই জমি নির্বাচন করতে হবে। এজন্য মাঝারী উঁচু জমি মাছ চাষের উপযোগী।
- মাটির পানি ধারণক্ষমতা বেশি থাকতে হবে। এজন্য এঁটেল বা দো-অাঁশ মাটি হলেই ভালো।
- জমিতে যেন ধান কাটা পর্যন্ত ৪-৬ মাস পানি থাকে।
- নির্বাচিত জমি গভীর নলকূপ বা স্থায়ী জলাধারের পাশে হওয়া উচিত, যাতে সহজেই জমিতে প্রয়োজন মত পানি দেওয়া যায়।
- জমিটি বাড়ীর যতটা সম্ভব কাছাকাছি হওয়া ভালো।
জমি প্রস্ত্ততকরণ
ধানী জমিকে মাছ চাষের জন্য মাছের বাস উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। জমি যত ভালভাবে প্রস্ত্তত করা হবে তত বেশি ধান ও মাছের উৎপাদন পাওয়া যাবে। এজন্য জমি ভালভাবে চাষ দেওয়ার পর মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে যেন সর্বত্রই পানির গভীরতা সমান থাকে।
আইল নির্মাণ:
প্রয়োজনমত পানি ধরে রাখার জন্য জমির চারপাশে উঁচু ও শক্ত করে আইল বাঁধতে হবে। আইলের উচ্চতা ৫০ সেমি. এর ওপরে হলে ভালো এবং আইলের গোড়ার দিক অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত হওয়া উচিত যেন পানির চাপে আইল সহজে ভেঙ্গে না যায়। তবে আইলের উচ্চতা এমন হওয়া উচিত যেন বন্যার পানিতে ক্ষেত তলিয়ে না যায়। বর্ষার সময় ক্ষেতের অতিরিক্ত পানি যাতে আইল উপচিয়ে বেরিয়ে না যায় তার জন্য আইলের উপরিভাগে পানি নির্গমন পথ থাকতে হবে এবং নির্গমন পথে তাঁর বা নাইলনের জাল দিতে হবে যেন পানির সঙ্গে মাছ বেরিয়ে যেতে না পারে।
গর্ত ও নালা খনন
ধানক্ষেতে মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে নালা এবং গর্ত বা মিনি পুকুর অবশ্যই থাকতে হবে। নালা আইলের ভিতর জমির চারপাশে অথবা আড়াআড়িভাবে বা কোনাকুনিভাবে তৈরি করা যেতে পারে। জমির অপেক্ষাকৃত নিচু অংশে ১-২% এলাকা জুড়ে ৭৫-৯৫ সেমি গভীর করে গর্ত করতে হবে। গর্তের সঙ্গে নালার সংযোগ রাখতে হবে যাতে মাছ নালার মাধ্যমে সহজেই গর্ত থেকে ধানক্ষেতে এবং ক্ষেত থেকে গর্তে আসতে পারে। ছোট মাছ চাষের জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে ক্ষেতের ভিতরে বা বাইরে অপেক্ষাকৃত নিচু অংশে মিনি পুকুর করতে পারলে এবং পুকুর থেকে ক্ষেতের মধ্য দিয়ে নালার সংযোগ থাকলে ভাল হয়।
জমিতে নালা ও গর্ত করার উদ্দেশ্য
- খরা ও শুষ্ক মৌসুমে ক্ষেতের পানি কমে গেলে অথবা পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মাছ নালা/গর্তে/পুকুরে আশ্রয় নিতে পারে।
- ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হলে পানি কমিয়ে মাছকে নালা বা গর্তে রেখে কীটনাশক প্রয়োগ করলে মাছের কোন ক্ষতি হয় না।
- মাছ ধরার সময় পানি কমিয়ে নালা বা গর্তে সমস্ত মাছ একত্রিত করে সহজেই ধরা যায়।
- বড় গর্ত বা মিনি পুকুর থাকলে দ’ুফসলা পদ্ধতিতে ধানক্ষেতে মাছ চাষ করা সুবিধাজনক। এছাড়া ধান কাটার পরে গর্তে/পুকুরে মাছ রেখে বড় করা যায়। এতে আর্থিকভাবে যথেষ্ট লাভবান হওয়া যায়।
সার প্রয়োগ
ধান ও মাছের উৎপাদন বেশি পেতে হলে ক্ষেতে প্রয়োজন মত সার প্রয়োগ করা উচিত। মাটির উর্বরতা ও ধানের জাতের তারতম্য অনুসারে সারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের জন্য প্রতি শতক জমিতে ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৪০০-৫০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২০০-২৫০ গ্রাম এমপি সার দেওয়া যেতে পারে। টিএসপি ও এমপি সার জমি তৈরির সময় একবারই প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সার সমান তিন কিস্তিতে অর্থাৎ ধান রোপনের ৩০-৩৫ দিন, ৪৫-৫০ দিন এবং ৬০-৬৫ দিন পরে প্রয়োগ করতে হয়। সঙ্গে ৬-১০ কেজি গোবর জমি তৈরির সময় দিলে ভাল হয়। গোবর সার প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সারের পরিমাণ কম হলেও চলে।
ধানের জাত নির্বাচন ও চারা রোপন পদ্ধতি
ধানের সাথে মাছ চাষের ক্ষেত্রে ধানের জাত নির্বাচনে নিম্ন বিষয়সমূহ লক্ষ্য রাখতে হবে-
- যেসব ধান উচ্চ ফলনশীল এবং অধিক পানি সহ্য করতে পারে ও সহজে হেলে পড়েনা।
- যেসব ধানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং পোকার আক্রমণ কম হয়।
- সমুদ্র উপকুলীয় এলাকার জন্য নির্বাচিত ধানের লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
- উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের মধ্যে বিআর-৩ (বিপ্লব), বিআর-১১ (মুক্তা) ও বিআর-১৪ (গাজী) অন্যতম।
ধানের সাথে মাছ চাষ করতে ধানের চারা সারিবদ্ধভাবে এবং সমান দূরত্বে লাগাতে হবে, যাতে মাছ ধানক্ষেতে সহজে চলাফেরা করতে পারে। চারা লাগানোর সময় গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেমি. দিতে হবে। তবে জোড়া সারি পদ্ধতিতে ১৫ সেমি. ও ৩৫ সেমি দূরত্বে লাগালে ভাল হয়। এ পদ্ধতিতে দুই সারির মধ্যকার দূরত্ব ১৫ সেমি. করে এক জোড়া এবং এক জোড়া সারি থেকে অপর জোড়া সারির দূরত্ব ৩৫ সেমি. হতে হবে। এর ফলে মাছ সহজেই ধানক্ষেতে চলাচল করতে পারে ও প্রচুর সূর্যালোক পায়, মাছের খাদ্যের প্রাচুর্যতা বেড়ে যায় এবং ধান ও মাছের ফলন বেশি হয়।
মাছের প্রজাতি নির্বাচন ও পোনা মজুদ
ধানক্ষেতে পানির গভীরতা কম থাকাতে পানির তাপমাত্রা এবং পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া ধানক্ষেতে অল্প সময়ের জন্য মাছ রাখা হয়, তাই এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য প্রজাতি নির্বাচনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।
- নির্বাচিত মাছ দ্রুত বর্ধনশীল হতে হবে।
- কম গভীর পানিতে স্বাচ্ছন্দে বাস করতে পারে এবং তাড়াতাড়ি বড় হয়।
- তাপমাত্রা ও পরিবেশের তারতম্য সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
- ধানের কোন ক্ষতি করে না।
এসব বিবেচনা করে এ পদ্ধতির জন্য মিরর কার্প, সরপুঁটি, মলা ও চিংড়ি নির্বাচন করা যেতে পারে। নিম্নে এসব প্রজাতির মিশ্র চাষের প্রতি শতকে মজুদ ঘনত্ব দেওয়া হলো।
- নমুনা-১: মলা: ৫০-৬০টি, মিরর কার্প: ৬-৮টি, সরপুঁটি: ১০-১২টি, মোট: ৬৬-৮০টি।
- নমুনা-২: মলা: ৬০-৬৪টি, চিংড়ি: ৩৬-৪০টি, মোট: ৯৬-১০৪টি।
পোনার মজুদ ঘনত্ব সাধারণত পোনার আকার, প্রজাতি এবং ক্ষেতের উর্বরতার ওপর নির্ভর করে। যেহেতু এ পদ্ধতিতে মাছকে অল্প সময়ের জন্য রাখা হয় সেহেতু বড় আকারের পোনা ছাড়া উচিত। এজন্য পুঁটি ও মিরর কার্প পোনার আকার ৯ সেমি. এর ওপর হলে ভাল হয়। পানির তাপমাত্রার তারতম্যের জন্য পোনা মারা যেতে পারে বিধায় পোনা ধানক্ষেতে ছাড়ার পূর্বে অবশ্যই খাপ খাইয়ে অর্থাৎ তাপমাত্রা সাম্যবস্থায় এনে পোনা ছাড়তে হবে। ধান লাগানোর ১৫-২০ দিন পর পোনা ছাড়া উচিত। ধান লাগানোর পর পর পোনা ছাড়লে মাছের চলাচলের কারণে ধানের চারা আলগা হয়ে উঠে যেতে পারে।
পানি সরবরাহ
মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ধানী জমিতে সব সময় কমপক্ষে ১৮ সেমি ওপরে পানি রাখা উচিত। তবে প্রথম দিকে পানির গভীরতা বেশি হওয়া উচিত নয়, কারণ এতে চারা গাছ গোছা নিতে পারে না। তাই প্রথম দেড় মাস পর্যন্ত ১২-২০ সেমি. পানি রাখতে হবে এবং এরপর ধীরে ধীরে পানির গভীরতা বাড়ানো যেতে পারে।
খাদ্য প্রয়োগ
ধানের সাথে মাছ চাষের জন্য বাইরে থেকে খাদ্য দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে বেশি উৎপাদন পাওয়ার জন্য মাছের দেহের ওজনের ২-৩ শতাংশ হারে সরিষার খৈল ও চালের কুড়া ১ঃ২ অনুপাতে প্রতিদিন গর্তে বা ধানক্ষেতে প্রয়োগ করতে হবে।
পোকা-মাকড় দমন
ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে সাধারণত পোকার আক্রমন তেমন হয় না। যদি কোন পোকার আক্রমন দেখা দেয় তাহলে ক্ষেতের পানি কমিয়ে মাছকে গর্ত বা নালার মধ্যে রেখে কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। কীটনাশক ব্যবহারের ৪-৫ দিন পর জমিতে পানি ভর্তি করলে মাছ গর্ত বা নালা থেকে ক্ষেতে বের হয়ে আসবে। এছাড়া ধানক্ষেতে গাছের ডাল অথবা বাঁশের কঞ্চি পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করলে পোকার আক্রমন বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মাছ আহরণ
ধান কাটার পর পানি কমিয়ে ক্ষেত থেকে মাছ ধরতে হবে। তবে সকালের দিকে তাড়াতাড়ি ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে মাছ ধরে ফেলা উচিত। এতে মাছ সতেজ থাকে ও বিক্রয় মূল্য বেশি হয়। ধানের সঙ্গে মাছ চাষ করলে প্রতি শতাংশে এক ফসলা পদ্ধতিতে ১.৩০-২.৬০ কেজি এবং দু’ফসলা পদ্ধতিতে ২.৪০-২.৮০ কেজি মাছের উৎপাদন পাওয়া যায়। আর মলা ও চিংড়ি চাষ করলে প্রতি শতাংশে এক ফসলা পদ্ধতিতে ০.০৬-০.০৭ কেজি মলা ও ০.৮৫-০.৯৫ কেজি চিংড়ি এবং দু’ফসলা পদ্ধতিতে ০.২৪-০.২৮ কেজি মলা ও ১.৩২-১.৪৭ কেজি চিংড়ি উৎপাদন করা যায়।
তথ্যসূত্র: DoF, Bangladesh