মাছের খাদ্যের পরিমাপ সাধারণত দু’ভাবে নির্ণয় করা যায়। যথা-

  1. দৈহিক ওজনের শতকরা হার পদ্ধতি (প্রচলিত)
    সাধাণত মাছ চাষিগণ মাছের খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুকুরের মাছের মোট দেহিক ওজনের শতকরা হারে খাদ্য প্রয়োগ করে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা যে পদ্ধতি ব্যবহার করেন তা হচ্ছেঃ ৪০ শতাংশের একটি পুকুরে যদি প্রতি শতাংশে ১৫০টি ঘনত্বে প্রতিটি ১০০ গ্রাম ওজনের ৬০০০টি পাঙ্গাস মাছ থাকে তাহলে মাছের মোট দৈহিক ওজন হবে ১০০ গ্রাম × ৬০০০ = ৬০০ কেজি। ৬% হারে খাদ্য প্রয়োগ করলে দৈনিক ৩৬ কেজি খাদ্য উক্ত পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে যা অনেকটাই অনুমান নির্ভর। মাছ চাষিগণ এ পদ্ধতিতে খাদ্য প্রয়োগ করে ব্যর্থ হয়েছেন বা ভুল করছেন তা আমার বক্তব্য নয়। কারণ দীর্ঘ দিন ধরে দেশের মৎস্য বিজ্ঞানীগণ চাষিদেরকে এ পদ্ধতিটি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। একটা সময় ছিল যখন লাভের অঙ্কটা ছিলো অবিশ্বাস্য এবং সে কারণেই কিছুটা অপচয় হলেও চাষিগণ পর্যাপ্ত পরিমাণ লাভ করতে পেরেছেন। কিন্তু বর্তমানে লাভের পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে চলে আসায় খাদ্য অপচয় মাছ চাষের ক্ষেত্রে লোকসানের অন্যতম একটি কারণ বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে ১০০ গ্রাম ওজনের মাছটির দৈনিক খাদ্য চাহিদা কত গ্রাম বা দৈনিক বৃদ্ধি হার (Daily Growth Rate) কত গ্রাম তা না জেনেই খাদ্য প্রয়োগ করছেন যা মাছের উৎপাদন খরচের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
  2. চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি
    সাধারণত প্রতিটি মাছের নির্দিষ্ট দৈহিক ওজন অনুযায়ী দৈনিক বৃদ্ধির একটা নির্দিষ্ট হার আছে যা অধিক খাদ্য প্রয়োগ করলেও সেই নির্দিষ্ট হার অতিক্রম করার কথা নয়। যেমন, একটি নির্দিষ্ট বয়স বা ওজনে একটি মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি যদি ২ গ্রাম হয় আর সে অবস্থায় দৈনিক ৬ গ্রাম খাদ্য প্রদান করলেও বৃদ্ধি ২ গ্রামের অধিক হবে না অর্থাৎ এক্ষেত্রে দৈনিক সর্বোচ্চ ৪ গ্রাম খাদ্য পেতে পারে। ১০০ গ্রাম ওজনের একটি পাঙ্গাশ মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রযুক্তি, মাছের জাত ইত্যাদি বিচার করলে ২.৫ গ্রামের উপরে নয়। আমরা জানি যে FCR (Feed Conversion Rate) অর্থাৎ খাদ্য রূপান্তর হার ২ এর অধিক হলে লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ে। দেশে বর্তমানে উৎপাদিত ও সর্বাধিক প্রচলিত মৎস্য খাদ্যের গুণগত মান ভেদে FCR ১:১.৭ থেকে ১:২। সে হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত মানের মাছের খাদ্য ১০০ গ্রাম ওজনের একটি পাঙ্গাশ মাছকে দৈনিক সর্বোচ্চ ৫ গ্রামের বেশি দেয়া যায় না। সূত্রটি হচ্ছেঃ দৈনিক গড় বৃদ্ধির হার X খাদ্য রূপান্তর হার = খাদ্যের চাহিদা (Average DGR X FCR)= Demand of Food)। এই পদ্ধতিতে খাদ্য প্রয়োগ করলে উপরে উল্লিখিত ১০০ গ্রাম ওজনের ৬০০০ টি পাঙ্গাশের পুকুরে দৈনিক খাদ্যের প্রয়োজন হবে ৫ গ্রাম X ৬০০০ = ৩০ কেজি। এতে দেখা যায়, দ্বিতীয় পদ্ধতি ব্যবহার করলে খাদ্যের সাশ্রয় হয় ৬ কেজি। এই অতিরিক্ত ৬ কেজি খাদ্য হয়তো পুকুরে পচনের ফলে পানির গুণগত মান নষ্ট হতো অথবা তা মাছ খেলেও দৈহিক বৃদ্ধিতে কোনো কাজে লাগতো না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য পরিপাকের পূর্বেই তা মল হিসাবে বের হয়ে যায়। পানির নিচে এ জাতীয় অপচয় সাধারণ মাছ চাষিদের ক্ষেত্রে বুঝতে পারা একটু কঠিন। অথচ ধীরে ধীরে এ জাতীয় অপচয়ই প্রতি কেজি মাছের উৎপাদন খরচ অনেক বাড়িয়ে দেয়।

চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতির উদাহরণ:
এক্ষেত্রে দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত পাঙ্গাস চাষের পুকুরে দৈনিক প্রতিটি মাছের মাথাপিছু কত গ্রাম খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে তার তালিকা- ৫০ থেকে ৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ১.৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৩ গ্রাম, চাষকাল ৩৩ দিন। ১০০ থেকে ১৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ২ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৪ গ্রাম, চাষকাল ৫০ দিন। ২০০ থেকে ২৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৩ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৬ গ্রাম, চাষকাল ৩৩ দিন। ৩০০ থেকে ৩৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৪ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৮ গ্রাম, চাষকাল ২৫ দিন। ৪০০ থেকে ৪৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১০ গ্রাম, চাষকাল ২০ দিন। ৫০০ থেকে ৫৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৬ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১২ গ্রাম, চাষকাল ১৭ দিন। ৬০০ থেকে ৬৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৭ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১৪ গ্রাম, চাষকাল ১৪ দিন। ৭০০ থেকে ৭৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৭.৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১৫ গ্রাম, চাষকাল ১৩ দিন। ৮০০ থেকে ৮৯৯ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৮ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১৬ গ্রাম, চাষকাল ১১ দিন ও ৯০০ থেকে ১০০০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৯ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ১৮ গ্রাম, চাষকাল ১০ দিন। এভাবে একটি পাঙ্গাস চাষের পুকুরে ৫০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজন হতে ২২৫ দিন/৭ মাস ১৫দিন চাষকাল লাগতে পারে। ২২৫ দিন চাষকাল শুধু পূর্ণমাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ কালকে হিসাব করা হয়েছে। শীতকালে খাদ্য বিরতির সময় হিসাবে আসবে না। তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে পোনার গুণগত মান, চাষির দক্ষতা ও খামার ব্যবস্থাপনার মানের উপর ফলাফল এর চাইতে কিছুটা ভালমন্দ হতে পারে।
তেলাপিয়া চাষিদের সুবিধার্থে তেলাপিয়া মাছের দৈনিক মাথাপিছু গ্রাম হিসাবে খাদ্য প্রয়োগের তালিকা- ১০ থেকে ৫০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ১.২৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ২.৫ গ্রাম, চাষকাল ৩২ দিন। ৫১ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ১.৭৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৩.৫ গ্রাম, চাষকাল ২৮ দিন। ১০১ থেকে ১৫০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ২.২৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৪.৫ গ্রাম, চাষকাল ২২ দিন। ১৫১ থেকে ২০০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ২.৭৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৫.৫ গ্রাম, চাষকাল ১৮ দিন। ২০১ থেকে ২৫০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৩.২৫ গ্রাম দৈনিক খাদ্যের চাহিদা ৬.৫ গ্রাম, চাষকাল ১৬ দিন। ২৫১ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের মাছের দৈনিক গড় বৃদ্ধি ৩.৭৫ গ্রাম এবং খাদ্যের চাহিদা ৭.৫ গ্রাম, চাষকাল ১৩ দিন। এভাবে চাষের পুকুরে তেলাপিয়া মাছ ১২০ থেকে ১৪০ দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজন হতে পারে।
 
সাশ্রয়ী পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ চাষিগণ নিম্নলিখিত উপকারসমূহ পেতে পারেন

  • খাদ্যের অপচয় কম হবে
  • খাদ্যের পচনজনিত কারণে পানির গুণগত মান নষ্ট হবে না
  • দৈহিক ওজন ও দৈনিক বৃদ্ধি সম্পর্কে অবগত থাকা ও খাদ্যের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
  • মাছের মৃত্যুহার কম হয়
  • মাছের উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকায় লাভ নিশ্চিত করা যায়।

 
উল্লেখিত ফলাফল পেতে শর্তসমূহ

  • প্রতি দশ দিন পর পর মাছের ওজন পরীক্ষা করে পর্যায়ক্রমিক দৈনিক গড় বৃদ্ধি (গ্রাম) জানতে হবে।
  • মাছের একক চাষ হলে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে যা মিশ্র চাষে পাওয়া যায় না।
  • খাদ্য সুষম হতে হবে, বিশেষ করে আমিষের শতকরা হার জানা থাকতে হবে।
  • বিভিন্ন প্রজাতির মাছের/যে মাছটি চাষ করা হয়েছে এদের বিভিন্ন বয়স বা ওজনে দৈনিক গড় বৃদ্ধির হার (গ্রাম হিসাবে) সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। যেমন, ৫০০ গ্রাম ওজনের একটি পাঙ্গাশ মাছের দৈনিক বৃদ্ধি ৬ গ্রামের ওপরে নয়।

এ পদ্ধতি ব্যবহার করে এক জন চাষি প্রতি কেজি মাছ উৎপাদনে ন্যুনতম ৫ টাকা সাশ্রয় পেতে পারেন যেখানে অনেক সময় বাজার দর ও দালালদের দৌরত্বের কারণে কেজি প্রতি ৫ টাকা লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সাশ্রয়ী পদ্ধতির মূল বিষয়টি হচ্ছে প্রথমে মাছের খাদ্যের চাহিদা নির্ণয় করে অতঃপর খাদ্য প্রয়োগ। আশা করি, মাছ চাষি ভায়েরা সাশ্রয়ী পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে উপকৃত হবেন।
 
তথ্যসূত্র:

Answer for মাছের খাদ্য পরিমাপ সম্বন্ধে জানতে চাই