প্রাকৃতিক পরিবেশগত ও মনুষ্যসৃষ্ট নানাবিধ কারণে মুক্ত জলাশয়ে এসব মাছের প্রাচুর্য্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় যে সমস্ত কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব মাছের প্রাচুর্য্যতা হ্রাসের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
আবাসস্থলের সংকোচন ও অবক্ষয়ঃ দেশে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়নমুলক কর্মকান্ড যেমন- বন্যা নিয়স্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত জনপথ ও সেচ খাল নির্মাণ, যত্র-তত্র নদ-নদী ভরাট করে গৃহ নির্মাণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আবাসস্থলের সংকোচনের ফলে এসব মাছের প্রজনন বিঘ্নিত হচ্ছে এবং মাছের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। তাছাড়া প্লাবনভুমি, খাল-বিলসহ অন্যান্য নিচু এলাকা মাটি ভরাট করে কৃষি জমিতে রূপান্তর হচেছ; ফলে মাছের আবাসস্থলের আয়তনও কমে যাচ্ছে। অধিকন্তু এসব মাছের প্রকৃত অবাসস্থল তথা প্রাকৃতিক জলাশয়ের ইকোসিষ্টেমে মারাত্মক পরিবর্তন সাধন যেমন- জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া, জলাশয় পুরোপুরি শুকিয়ে ফেলার ফলে বেনথোসসহ পুকুরের তলদেশে বসবাসকারী অন্যান্য জীবের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় এসব মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অধিক আহরণঃ জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে স্বাভাবিকভাবে মুক্ত জলাশয়ে কৈ, শিং ও মাগুর মাছসহ অন্যান্য দেশীয় মাছ আহরণ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে একদিকে যেমন জলাশয়ের মজুদ হ্রাস পাচ্ছে; অন্যদিকে নানাবিধ কারণে ঠিক সে অনুপাতে এসব মাছ আশানুরূপ উৎপাদন হচ্ছে না।
কৃষিজমিতে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারঃ বর্তমানে কৃষিকাজে বিশেষ করে উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। ব্যবহৃত কীটনাশকের বিষক্রিয়ার প্রভাব প্লাবনভুমি ও মুক্ত জলাশয়ে পড়ছে; ফলে কৈ, শিং ও মাগুর মাছের বিচরণ ও আবাসস্থল অনেকাংশে বিনষ্ট হচ্ছে। এমনকি কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় প্রজনন ক্ষেত্রসহ ছোট ছোট পোনা, ডিম পোনা ইত্যাদি নষ্ট হচ্ছে।
প্রজননক্ষেত্র কমে যাওয়াঃ প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন মৌসুমে কৈ, শিংও মাগুর মাছ মূলতঃ নিজ আবাসস্থলের আনাচে-কানাচে নিমজ্জিত আগাছা ও উদ্ভিদ, গাছের ডাল-পালা, ধানক্ষেত, পাটক্ষেত ইত্যাদিতে প্রজনন কার্যক্রম সম্পন্ন করে। এমনকি নিজ আবাসস্থলে এসব সুযোগ সুবিধা না থাকলে তারা প্রজনন সম্পন্ন করার জন্য অন্যত্র মাইগ্রেশন করে । জনসংখ্যার চাপে উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের দিকে নজর দেয়ার ফলে এবং অন্যান্য নানাবিধ কারণে এসব মাছের প্রজননক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। ফলশ্রূতিতে প্রাকৃতিকভাবে এসব মাছের প্রজনন কার্যক্রমের সুযোগ দিন দিন সংকোচিত হয়ে পড়ছে।
নদ-নদীতে পলি জমাঃ খাল-বিল ও নদ-নদীতে ব্যাপকহারে পলি জমার ফলে একদিকে যেমন তাদের উৎস মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে হাওর-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা হ্রাস পেয়ে পর্যায়ক্রমে সেগুলো ধানক্ষেতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন নদ-নদী খনন না করায় এবং বিভিন্ন বাঁধের কারণে শুকনো মৌসুমে প্রায় সব ছোট ছোট নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং পলি জমার পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য দেশীয় ছোট মাছসহ কৈ, শিং ও মাগুর মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে।
পরিবেশ দূষণঃ শিল্প কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ নদ-নদী ও মুক্ত জলাশয়ে ফেলার ফলে বর্জ্য পদার্থের বিষক্রিয়ায় মুক্ত জলাশয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, এমনকি উক্ত বিষক্রিয়ায় মাছ মারাও যাচ্ছে।
মাছের ক্ষতরোগঃ দেশীয় প্রজাতির প্রায় সব মাছ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মাছের ক্ষতরোগ। আমাদের দেশে ১৯৮৮ সনে প্রথম এ রোগের প্রার্দুভাব দেখা যায় । সে সময় দেশের প্রায় সব ধরণের জলাশয়ে ক্ষতরোগের ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছ যেমন- কৈ, মাগুর, শিং, টাকি, মেনি, শোল, পুঁটি, টেংরা ইত্যাদি মাছ ব্যাপকহারে মারা যায় এবং প্রাকৃতিক মজুদ অনেকাংশে হ্রাস পায়।
নির্বাচিত কিছু মাছ চাষে বিষ প্রয়োগে অন্যান্য মাছ নিধনঃ কার্প ও অন্যান্য বিদেশী কিছু মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর প্রস্ততির অংশ হিসেবে অন্যান্য ছোট মাছ মেরে ফেলার কারণে দেশীয় প্রজাতির প্রায় সব মাছই ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। উল্লেখ্য যে, নববই দশকের আগে গ্রামীণ পুকুরের প্রায় প্রতিটিতে অন্যান্য মাছের সাথে কৈ, শিংও মাগুর মছসহ দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ পাওয়া যেত কিন্তু পরবর্তীতে পুকুর প্রস্তুতির সময়ে উক্ত মাছগুলোকে অবাঞ্চিত মাছ হিসেবে মেরে ফেলা হত, ফলে এসব মাছ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
কারেন্ট জালের ব্যাপক ব্যবহারঃ প্লাবনভুমিসহ প্রায় সব ধরণের জলাশয়ে নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ নিধন হচ্ছে।
 
তথ্যসূত্র: DoF

Answer for কৈ, শিং ও মাগুর মাছের প্রাচুর্য্যতা হ্রাসের কারণ কি?